সুপার সাইক্লোন সিডরের ১৪ বছর পূর্তি আজ। ২০০৭ সালের এই দিনে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে আঘাত হেনেছিল এই ট্রপিক্যাল সাইক্লোন। এর ধ্বংসলীলায় মুহূর্তেই পাল্টে যায় উপকূলীয় জনপদের জীবন। সেই দুঃসহ স্মৃতিতে এখনও আঁতকে সেখানকার মানুষ।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, সিডরের আঘাতে বরগুনা জেলায় ১ হাজার ৩৪৫ জন মারা যান, নিখোঁজ হয়েছেন ১৫৬ জন। ঝড়ের কবলে মারা পড়ে ৩০ হাজার ৪৯৯টি গবাদি পশু ও ৬ লাখ ৫৮ হাজার ২৫৯টি হাঁস-মুরগি।
জেলার ২ লাখ ১৩ হাজার ৪৬১টি পরিবারের সবাই কমবেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। গৃহহীন হয়ে পড়ে ৭৭ হাজার ৭৫৪টি পরিবার।
বরগুনায় সিডরের আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সদর উপজেলার নলটোনা গ্রাম। এই গ্রামে সিডরের এক বছর আগে থেকেই ছিল না কোনো বেড়িবাঁধ। সিডরের সময় এ জায়গায় জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ২০ ফুটের মতো।
ঘূর্ণিঝড়ের পরদিনই সেখানে অর্ধশতাধিক মানুষের লাশ পাওয়া যায়। তখনও এলাকাটি পানির নিচে তলিয়ে ছিল। লাশ দাফনের জন্য কোনো জায়গাও পাওয়া যাচ্ছিল না।
লাশগুলো আনা হয় বরগুনা-নিশানবাড়িয়া সড়কের পাশে পশ্চিম গর্জনবুনিয়া গ্রামে। দাফনের কাপড় ছাড়াই ২৯ জনকে ১৯টি কবরে দাফন করা হয়। জায়গার অভাবে চারটি কবরে তিনজন করে ১২ জন, তিনটি কবরে দুজন করে ৬ জন ও ১২টি কবরে একজন করে ১২ জনের লাশ দাফন করা হয়। কবরগুলোকে একটু উঁচু করে রাখা হয়।
সে সময় বরগুনা প্রেস ক্লাবের সহযোগিতায় সংগ্রাম নামের স্থানীয় একটি উন্নয়ন সংস্থা প্রাথমিকভাবে ইট দিয়ে কবরস্থানটি ঘিরে দেয়।
বরগুনা প্রেস ক্লাবের সহযোগিতায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসন সেখানে সিডর স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছে। সারিবদ্ধ কবর দেখে মানুষ এখনও সেখানে এসে থমকে দাঁড়ায়। ভয়াল সেই রাতের স্মৃতি হয়ে আছে এসব কবর।
নলটোনা গ্রামের তাসলিমা বেগমের বাবা, মা ও ছেলের মৃত্যু হয়েছিল সিডরে। ভয়াল সে রাত আর স্বজনদের কথা মনে করে এখনও ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি।
তাসলিমা বলেন, ‘বইন্না ছোডার পর মোরা ঘরদিয়া নামি নাই। আচুক্কা (হঠাৎ) দেহি ঘরে পানি হানতে (ঢুকতে) আছে। ঘরডা যহন তলায় তহন নাইম্মা হাতর (সাঁতার) দিছি, কোম্মে উইট্টা পড়ানডা বাঁচান যায়। গাছের ডাল ধইর্যা ঝুইল্লা রইছি হাঙ্গরাইত (সারা রাত)। বেইন্নাহালে (সকালে) পানি কমছে পর নামছি মোর পোলা আর মা-বাপরে বিছরাইতে। যাইয়া দেহি মানসে রাস্তায় মরা হোয়াইয়া রাকছে। হেরা কাফন গোসল ছাড়াই কবর দিয়া দেছে।’
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির বরগুনা সদর উপজেলার সমন্বয়ক জাকির হোসেন মিরাজ বলেন, ‘ওই সময় আবহাওয়া বিভাগের সতর্কবাণী যথাযথ ছিল না। আবহাওয়া অফিস ৪ নম্বর সতর্ক সংকেত থেকে হঠাৎ ১০ নম্বর বিপদ সংকেতের ঘোষণা দেয়। মোংলা সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্র করে যে সতর্ক সংকেত প্রচার করা হয়েছিল, তা বোঝার উপায় বরগুনার মানুষের ছিল না। সিংহভাগ মানুষ ঘরেই ছিল, রাতের আঁধারে বানের জল দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটতে গিয়েই এত প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।’
উন্নয়ন সংগঠন ‘জাগো নারী’র প্রধান নির্বাহী হোসনেয়ারা হাসি বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকায় ঝড়-জলোচ্ছ্বাস হবেই, মানুষের এগুলো ঠেকানোর উপায় নাই। তবে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে। মানুষ সতর্ক সংকেত শুনে যেন নিরাপদে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারে, সে ব্যাপারে সরকারকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়ার আহ্বান জানাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের সতর্ক সংকেত স্থানীয় ভাষায় বোধগম্য করে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য ঘূর্ণিঝড় কর্মসূচির স্বেচ্ছাসেবকসহ বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।’
বরগুনা পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক হাসানুর রহমান ঝন্টু বলেন, ‘সিডর উপকূলীয় এলাকার মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে। তবে সিডর বুঝিয়ে গিয়েছে যে দুর্যোগের সংকেতে যথাসময়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতেই হবে। সিডর-পরবর্তী ঘূর্ণিঝড়গুলোতে আমরা দেখেছি, মানুষ আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে এবং প্রাণহানি কমেছে। ক্ষতিও কমেছে। ১৪ বছরে আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। শিখেছি দুর্যোগ থেকে উত্তরণের উপায়। এখন আমাদের জরুরি দরকার স্থায়ী সুরক্ষার জন্য সরকারি পদক্ষেপ।’
বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সিডর বাংলাদেশের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি, যা কেড়ে নিয়েছে উপকূলবাসীর সহায়-সম্বল, কেড়ে নিয়েছে আপনজনদের। এ ক্ষতি অপূরণীয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘সিডরের পরপরই সরকারি-বেসরকারি, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা বরগুনার মানুষের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ দুর্যোগ মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। ১৪ বছর পর এখন উপকূলীয় এলাকার মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বরগুনার কৃষিতে সমৃদ্ধি এসেছে। পরিবেশের বিরুপ প্রভাব মোকাবিলায় সক্ষমতা বেড়েছে। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের পাশে দাঁড়ানোর।’