নির্বাচন আইসিইউতে আছে মন্তব্য করে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অসহিষ্ণু মনোভাব গণতন্ত্রকে অন্তিম অবস্থায় নিয়ে গেছে।
রোববার ‘দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ শীর্ষক এক লিখিত বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন সময়ে দেয়া বক্তব্যের জন্য আলোচিত এ কমিশনার বলেন, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ যতই ফুরিয়ে আসছে, নির্বাচনব্যবস্থা ও অবস্থা দেখে ততই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছি। আজও রূপকার্থে কিছু কথা বলতে চাই। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন এখন আইসিইউতে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে গণতন্ত্র এখন লাইফ সাপোর্টে। কথাগুলির বাখ্যা করা যেতে পারে।’
দেশে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অসহিষ্ণু মনোভাবকে এর জন্য দায়ী করেছেন মাহবুব তালুকদার।
তিনি বলেন, ‘খেলায় যেমন পক্ষ-বিপক্ষের প্রয়োজন হয়, তেমনি একপক্ষীয় কোনো গণতন্ত্র হয় না। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যেকোনো মূল্যে গণতন্ত্রকে আমরা লাইফ সাপোর্ট থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চাই।’
দল-মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার ওপর জোর দিয়ে মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘আমি আবারও পুনরাবৃত্তি করে বলতে চাই, এই সংকট নিরসনে সকল দলের সমঝোতা অপরিহার্য।’
সংবিধানের বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও ৫০ বছরে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়ন না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন এ কমিশনার।
তিনি বলেন, ‘নির্বাচন প্রক্রিয়া সংস্কারের জন্য এই আইন প্রণয়ন অবধারিত হলেও তা যথেষ্ট নয়। এতে নিরপেক্ষভাবে সব রাজনৈতিক দলের স্বার্থ সংরক্ষণ করা আবশ্যক এবং তা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়।
‘একপক্ষীয় আইন করে কোনো লাভ হবে না। একপক্ষীয় আইন কেবল একদলীয় শাসনের পথ উন্মুক্ত করে। বিষয়টির যত তাড়াতাড়ি ফয়সালা হয়, ততই মঙ্গল। নইলে দেশব্যাপী নৈরাজ্যের আশঙ্কা আছে।’
দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে ‘রক্তাক্ত নির্বাচন’ বললে ‘অত্যুক্তি’ হবে না বলেও মন্তব্য তার।
জীবনের চেয়ে নির্বাচন বড় নয়, এই বার্তা সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছেন বলেই ভোটের আগে ও পরে ৩৯ জন নিহত হয়েছেন বলে মনে করেন তিনি।
মাহবুব বলেন, ‘১১ নভেম্বর ৮৩৪টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৮০ জন চেয়ারম্যান পদে আসীন হন। একে আক্ষরিক অর্থে নির্বাচন বলা যায় না। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, সেখানে নির্বাচন নেই।’
ইউপি নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না হলেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ থাকবে না বলে মনে করেন মাহবুব তালুকদার।
তিনি বলেন, ‘আমার মতে, পৃথক একটি স্থানীয় নির্বাচন কর্তৃপক্ষ গঠন করে এসব নির্বাচন করা যায়। যে নির্বাচন প্রক্রিয়া নির্বাচন কমিশন ঠিক করে না, তার দায় কমিশন কেন নেবে? তবে এই পরিবর্তন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার।’
জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের ‘রাজনৈতিক বাস্তবতার’ কারণে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের কিংবা নেতাদের ‘প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত মনোভাব’ অনুধাবন করে চলতে হয় বলেও মন্তব্য তার।
তিনি বলেন, ‘ফলে তারা (রিটার্নিং কর্মকর্তারা) হানাহানি, গোলযোগ ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো ধামাচাপা দিতে চান। তাদের ধামাধরা না হয়ে উপায় থাকে না। বিভিন্ন নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে আমার এই ধারণা হয়েছে। তাদেরকে নির্বাচনে সাহসী ভূমিকা পালনের কথা বলে লাভ নেই।’
স্থানীয় ক্ষমতাধরদের রোষানল থেকে রক্ষা করতে সাহসী রিটার্নিং অফিসার ও সাহসী কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা বা নিরাপত্তা দেয়ার নজির নেই বলেও লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেন মাহবুব তালুকদার।
কুমিল্লার লাকসাম ও চট্টগ্রামের রাউজানে ‘বিশ্বে আদর্শ নির্বাচনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন’ হয়েছে বলে বিদ্রূপ করেন মাহবুব তালুকদার।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাওয়া কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান, সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত সদস্য পদে ৬৫ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসন লাভ করেন। অন্যদিকে রাউজান উপজেলায় ১৪ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, ১২৬ জন পুরুষ ও ৪২ জন সংরক্ষিত আসনের সদস্য সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পদে আসীন হয়েছেন।’
দেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো উপজেলায় চেয়ারম্যান ও সদস্যের ১৮২টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা ঘটল বলে জানান তিনি।
মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘নির্বাচনে কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী বা প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় নির্বাচন ছিল খুবই শান্তিপূর্ণ। সারা দেশে যদি সন্ত্রাসমুক্ত এ ধরণের নির্বাচন করা যায়, তাহলে নির্বাচন কমিশনের বদলে একজন সচিবের অধীনে একটি সচিবালয় থাকলেই যথেষ্ট।’