বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি নিশ্চিত করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আহ্ছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অফিস অ্যাটেনডেন্ট দেলোয়ার হোসেন ও ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট পারভেজ মিয়া। তাদের কাছ থেকে এই নিশ্চয়তা পেয়ে পরীক্ষার্থী সংগ্রহে নেমে পড়েন একই ইউনিভার্সিটির টেকনিশিয়ান (হার্ডওয়্যার অ্যান্ড নেটওয়ার্ক) মুক্তারুজ্জামান রয়েল এবং বিভিন্ন ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় শনিবার আহ্ছানউল্লা ইউনিভার্সিটির টেকনিশিয়ান মুক্তারুজ্জামান রয়েল ও জনতা ব্যাংক গুলশান শাখার কর্মকর্তা শামসুল হক শ্যামল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ওই জবানবন্দিতে তারা এমন তথ্য জানান।
মুক্তারুজ্জামান রয়েল জবানবন্দিতে বলেন, ‘দেলোয়ার ও পারভেজ জানায় যে তারা পাঁচটি ব্যাংকে অফিসার ক্যাশ পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করতে পারবে। তাই আমার পরিচিত শ্যামলকে পরীক্ষার্থী সংগ্রহ করতে বলি। শ্যামল চারজন পরীক্ষার্থী নিয়ে আমার বাসায় আসে। আমি ও শ্যামল ৬ নভেম্বর সকাল ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ফাঁস হওয়া প্রশ্নগুলোর উত্তর পরীক্ষার্থীদের মুখস্থ করাই। আর ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের সঙ্গে বিকেলে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল ছিল।’
নির্ধারিত দিনে পরীক্ষার আগেই প্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নেয় প্রশ্নফাঁস চক্রের সদস্যরা। রয়েলও সেই টাকার ভাগ পান। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘৪ নভেম্বর শ্যামল আমাকে ৫০ হাজার টাকা দেয়। সেই টাকা আমি আর পারভেজ সমান ভাগ করে নেই।’
জনতা ব্যাংক গুলশান শাখার কর্মকর্তা শামসুল হক শ্যামল জবানবন্দিতে বলেন, ‘দেলোয়ার, পারভেজ ও মুক্তার আমার পূর্বপরিচিত। তাদের মাধ্যমে জানতে পারি যে, সমন্বিত পাঁচটি ব্যাংকের অফিসার ক্যাশ পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরির কাজটি টেন্ডারের মাধ্যমে আহ্ছানউল্লা ইউনিভার্সিটি পেয়েছে। দেলোয়ার, পারভেজ ও মুক্তার জানায় যে তারা ওই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগের রাতে ফাঁস করবে। তারা আমাকে পরীক্ষার্থী সংগ্রহ করতে বলে। আমি জানে আলমকে পরীক্ষার্থী সংগ্রহ করতে বলি। জানে আলম মিলন পরীক্ষার আগের রাতে চারজন পরীক্ষার্থী নিয়ে আমার কাছে আসে।’
প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে গ্রেপ্তার জানে আলম মিলনের কাছ থেকে এক লাখ টাকা পেয়েছেন বলে জানান শ্যামল। তা থেকে ৫০ হাজার টাকা মুক্তারকে দেন। মুক্তার তা পারভেজের সঙ্গে ভাগ করে নেন।
গত ৬ নভেম্বর বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির আওতায় রাজধানীর বিভিন্ন কেন্দ্রে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকে অফিসার (ক্যাশ) নিয়োগের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এক হাজার ৫১১টি পদের বিপরীতে এই পরীক্ষায় অংশ নেন এক লাখ ১৬ হাজার ৪২৭জন।
পরীক্ষা শেষে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ তোলেন পরীক্ষার্থীরা।
এদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে এমন তথ্য পেয়ে পরীক্ষার আগে থেকেই মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও বিভাগ তদন্ত শুরু করে। পরীক্ষার পর প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার সত্যতা মেলে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই ঘটনায় ১০ নভেম্বর রাজধানীর বাড্ডা থানায় মামলা করে ডিবি পুলিশ। মামলায় ২৮ জনের নাম উল্লেখ ছাড়াও অজ্ঞাত ২০ থেকে ২৫জনকে আসামি করা হয়।
পরীক্ষার দিন ৬ নভেম্বর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে পুলিশ পাঁচজনকে আটক করে। তারা হলেন-মোক্তারুজ্জামান রয়েল, শামসুল হক শ্যামল, জানে আলম মিলন, মোস্তাফিজুর রহমান মিলন ও রাইসুল ইসলাম স্বপন।
গত ১১ নভেম্বর আরো তিনজনকে গ্রেপ্তার করে তেজগাঁও গোয়েন্দা বিভাগ। তারা হলেন- এমদাদুল হক খোকন, সোহেল রানা ও ঢাকা কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী এবি জাহিদ।
প্রথম দফায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের পর ডিবি’র অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার জানান, কয়েকটি সরকারি ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা ও আহ্ছানউল্লা ইউনিভার্সিটির কয়েকজন মিলে প্রশ্ন ফাঁস করে। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পরীক্ষার্থীদের কাছে ৫ থেকে ১৫ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। টাকার বিনিময়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র নিয়েছেন এমন দু’শতাধিক পরীক্ষার্থীর তালিকা পাওয়া গেছে।
এদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অন্যতম দুই হোতা দেলোয়ার ও পারভেজ এখনও ধরা পড়েনি। ডিবি’র তেজগাঁও জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহাদাত হোসেন সুমা জানান, এই প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তার নাম পাওয়া যাচ্ছে। জড়িত অন্যদেরও গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
তিনি নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, আমরা গ্রেপ্তার আসামিদের রিমান্ডে নিয়েছি। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্রের আরো তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।