বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

যাবেন মগবাজার, ভাড়া দেবেন মতিঝিলের

  •    
  • ১৩ নভেম্বর, ২০২১ ১২:১২

নগর পরিবহনগুলোতে অবৈধ সিটিং সার্ভিসের নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় রীতিতে পরিণত হওয়ার পরের ধাপে ২০১৭ সালে আসে এই ওয়েবিল পদ্ধতি। এটি মূলত সিটিং সার্ভিস নামে চলা বাসগুলো একটি নির্ধারিত দূরত্বের পরপর কতজন যাত্রী উঠেছে, সেটি গণনা করার উপায়। একজন লাইনম্যান নির্ধারিত দূরত্ব পরপর বাসের একটি কাগজে যাত্রীর সংখ্যা লিখে দেন। পরে এটিই হয়ে যায় যাত্রী ঠকানোর নতুন কৌশল।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটির সামনে থেকে উত্তরা আবদুল্লাহপুর হয়ে ধউর চৌরাস্তা পর্যন্ত যায় মিনিবাস ভূঁইয়া পরিবহন। মোট দূরত্ব ২৫ দশমিক ২ কিলোমিটার। ভাড়া আসে ৫৪ টাকা। এক টাকা খুচরার ঝামেলা বলে নেয়া হয় ৫৫ টাকা।

এই পথে বিআরটিএ যে ভাড়া ঠিক করেছে, তাতে পাঁচটি স্টপেজে এক দূরত্ব থেকে আরেক দূরত্বে ১০ টাকা করে, একটি স্টপেজে ১৬ টাকা এবং একটি স্টপেজে ১২ টাকা ভাড়া ঠিক করা হয়েছে।

কিন্তু যেসব স্টপেজে ১০ টাকা করে ভাড়া ঠিক করা হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটিতেই নেয়া হচ্ছে ১৫ টাকা করে। যে স্টপেজে ঠিক করা হয়েছে ১৬ টাকা, সেটাতে নেয়া হচ্ছে ২০ টাকা। আর যে পথের ভাড়া ঠিক করা হয়েছে ১২ টাকা, সেখানেও নেয়া হচ্ছে ১৫ টাকা।

বিআরটিএ নিজেই ভাড়া নির্ধারণ করেছে কিলোমিটার হিসেবে, অথচ এখন এক দূরত্ব থেকে আরেক দূরত্বে ভাড়া ঠিক করেছে, যেটা এতদিন ধরে অবৈধ বলে আসা ওয়েবিলের মতোই।

ডিজেলের দাম পুনর্নির্ধারণের কারণে গত ৭ নভেম্বর ঢাকায় ডিজেলের বড় বাসে প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ২ টাকা ১৫ পয়সা আর মিনিবাসে ২ টাকা ৫ পয়সা নির্ধারণ করে দেয় বিআরটিএ। আর বড় বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ঠিক করা হয় ১০ টাকা, মিনিবাসে ৮ টাকা।

আবার বলে দেয় হয়, যেসব বাস সিএনজিতে চলে, সেগুলোতে ভাড়া বাড়বে না, আগের হারেই নিতে হবে ভাড়া।

কিন্তু কার্যক্ষেত্রে বাসগুলো এই হারের চেয়ে বেশি আদায় করত আগেই। আর এখন আদায় করছে আরও বেশি হারে।

এই বাসগুলো বেশি ভাড়া আদায়ে বছর পাঁচেক ধরে ওয়েবিল নামে একটি পদ্ধতি চালু করেছে, যাতে কিলোমিটারের কোনো হিসাব নেই। একটি দূরত্ব থেকে আরেকটি দূরত্ব পর্যন্ত ভাড়া ঠিক করেছে তারা। একটি নির্ধারিত দূরত্বের পর এক কিলোমিটার গেলেও পরের সেই ধাপের পুরোটার ভাড়া দিতে হয়।

গত বুধবার বাসমালিকদের সংগঠন সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতউল্লা সংবাদ সম্মেলনে এসে বলেন, রাজধানীতে কোনো সিটিং সার্ভিস আর ওয়েবিল থাকবে না। কিন্তু ঘোষণার পরেও বন্ধ হয়নি কোনো জায়গায়।

ভূঁইয়া পরিবহনের মোহাম্মদপুরের রিংরোডের সিনিয়র লাইনম্যান সোহেল হোসেন বলেন, ‘ওয়েবিল চেকআপের আগে উঠলে ১৫ টাকা দিতে হবে। আর ওয়েবিল চেকআপের পরে উঠলে ১০ টাকা ভাড়া দিতে হবে।’

তিনি জানান, তাদের বাসে শ্যামলী, আগারগাঁও, বনানী- এই ৩টি পয়েন্টে বাস চেকআপ করা হয়। জাপান গার্ডেন সিটি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ভাড়া ২০ টাকা। অথচ বিআরটিএর তালিকায় এই দূরত্ব দেখানো হয়েছে ৪ দশমিক ১ কিলোমিটার। বিআরটিএর হার অনুযায়ী এই দূরত্বে ভাড়া হওয়ার কথা ছিল ১০ টাকা।

আবার আগারগাঁও থেকে বনানীর কাকলী পর্যন্ত আরেক ওয়েবিলের ভাড়া ঠিক করা হয়েছে ১৫ টাকা। এই পথের দূরত্ব ৫ দশমিক ৭ কিলোমিটার। ভাড়া হয় ১২ টাকা।

আবার কোনো যাত্রী শ্যামলীর শিশুমেলা থেকে উঠে কাকলী নামলে তাকে ২০ টাকা দিতে হবে বলে জানান সোহেল। এই পথের দূরত্ব ৮ দশমিক ৩ কিলোমিটার। ভাড়া হওয়ার কথা ১৭ টাকা।

সোহেলের সঙ্গে থাকা লাইনম্যান রুবেল জানান, জাপান গার্ডেন থেকে আগারগাঁও চেক পয়েন্টের ৫ হাত দূরে নামলেও বাড়তি ১০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। আবার আগারগাঁওয়ের আগে থেকে কেউ যদি আড়াই কিলোমিটার দূরের বিজয় সরণিতে নামেন, তাহলেও তাকে কাকলী পর্যন্ত ২৫ টাকা ভাড়া দিতে হয়। কিন্তু কেউ যদি ওই চেক পয়েন্টের পরে ওঠেন, তাহলে ভাড়া দিতে হবে ১৫ টাকা।

নগর পরিবহনগুলোতে অবৈধ সিটিং সার্ভিসের নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় রীতিতে পরিণত হওয়ার পরের ধাপে ২০১৭ সালে আসে এই ওয়েবিল পদ্ধতি।

এটি মূলত সিটিং সার্ভিস নামে চলা বাসগুলো একটি নির্ধারিত দূরত্বের পরপর কতজন যাত্রী উঠেছে, সেটি গণনা করার উপায়। একজন লাইনম্যান নির্ধারিত দূরত্ব পরপর বাসের একটি কাগজে যাত্রীর সংখ্যা লিখে দেন। পরে এটিই হয়ে যায় যাত্রী ঠকানোর নতুন কৌশল।

বাড়তি ভাড়া আদায় ‘জায়েজ’ করতে প্রথমে এসব বাসে আসনের অতিরিক্ত যাত্রী তোলা হতো না। কিন্তু এখন যত খুশি তত ওঠে। যাত্রীরা এ নিয়ে তর্ক করলে শ্রমিকরা উল্টো স্বর গরম করে বলেন, ‘অফিস টাইমে দু-একজন উঠবেই।’ অথবা বলে, ‘সামনের মোড়েই নাইম্যা যাইব’ অথবা ‘অত চেতেন ক্যান? হেরা যাইব না?’

এই ওয়েবিলের নামে একটি স্টপেজ থেকে আরেকটি স্টপেজ পর্যন্ত একই হারে ভাড়া নির্ধারণ করা হলেও পুরোটা পথেই যাত্রী তোলা হয় আগের লোকাল বাসের মতোই। আবার ওয়েবিল এমন জায়গায় বসানো হয়, যেখানে যাত্রী নামে কম।

যেমন বিমানবন্দর সড়কে যাত্রী নামার একটি প্রধান জায়গা খিলক্ষেত বাসস্ট্যান্ড। কিন্তু ওয়েবিল বসানো হয়েছে ৫০০ থেকে ৬০০ মিটার আগের জোয়ার সাহারা এলাকায়। সেখানে যাত্রীর ওঠানামা খুবই কম।

এবার ফার্মগেট থেকে শাহবাগের দিকে যাওয়া বাসগুলোর বেশির ভাগের ওয়েবিল বসানো হয়েছে সোনারগাঁও হোটেলের নামনে। ২৫০ গজ দূরত্বে বাংলামোটর নামতে গেলেই তাকে ভাড়া দিতে হচ্ছে পরের গন্তব্য গুলিস্তান বা মতিঝিল পর্যন্ত।

আবার মহাখালী হয়ে সাতরাস্তা দিয়ে মগবাজার হয়ে মতিঝিল বা গুলিস্তানের দিকে চলা বাসগুলোর বেশির ভাগের ওয়েবিল সাতরাস্তার খানিকটা আগে। কেউ যদি মগবাজার নামতে চায়, তাহলে দেড় কিলোমিটার ‍দূরত্বের জন্য তার কাছ থেকে ভাড়া নেয়া হয় গুলিস্তান বা মতিঝিল পর্যন্ত।

৩ নম্বর এয়ারপোর্ট-বঙ্গবন্ধু এভিনিউ পরিবহনের বাসে ফার্মগেট থেকে উঠে বাংলামোটর বা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল বা শাহবাগ মোড়ে নামলে সর্বনিম্ন ভাড়া ৮ টাকা নেয়ার কথা। কিন্তু যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে গুলিস্তান বা বঙ্গবাজার পর্যন্ত যাওয়ার পথের পুরোটার ভাড়া হিসেবে ১৫ টাকা।

মালঞ্চ পরিবহন রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে দয়াগঞ্জে চলাচল করে। ওই বাসের সুপারভাইজার বিপ্লব মিয়া নিউজবাংলাকে তিনি জানান, মোহাম্মদপুর থেকে দয়াগঞ্জের ভাড়া ৩৫ টাকা। আর মোহাম্মদপুর থেকে গুলিস্তানের ভাড়া ২৫ টাকা।

ওই বাসে মোট ৩টি পয়েন্টে ওয়েবিল বসানো হয়েছে। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে ঝিগাতলা পর্যন্ত যেখানেই নামুক না কেন, ভাড়া ধরা আছে ১৩ টাকা, কিন্তু খুচরা না থাকার কথা বলে আদায় করা হয় ১৫ টাকা।

এর চেয়ে কম দূরত্বে ঝিগাতলা থেকে ঢাকা ক্লাব পর্যন্ত ভাড়া ঠিক করা হয়েছে আরও ১৩ টাকা, এখানেও আদায় করা হয় ১৫ টাকা। ঢাকা ক্লাব থেকে বঙ্গভবন পর্যন্ত আদায় করা হয় আরও ১৫ টাকা, কিন্তু কাগজে-কলমে লেখা ১৩ টাকা। বঙ্গভবন থেকে পুরান ঢাকার দয়াগঞ্জের জন্যও ১৩ টাকা নির্ধারণ করে আদায় করা হয় ১৫ টাকা।

অর্থাৎ ৩৫ টাকার মোট ভাড়া চার ভাগে আদায় করা হয় ৬০ টাকা।

আবার পুরো পথের ভাড়া নিয়ে নেয়ার পরেও সেই দূরত্বে যতগুলো মোড় বা লোকসমাগমের এলাকা আছে, সবগুলো থেকে যাত্রী তোলা হয়।

যেমন বৈশাখী পরিবহনের একটি বাসে শ্যামলীর শিশুমেলা ও ৬০ ফিটে এলাকায় কোনো ওয়েবিল রাখেনি। কিন্তু দুই জায়গায় দীর্ঘ সময় ধরে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করানো হলো।

একইভাবে জাহাঙ্গীর গেট, মহাখালী ওয়্যারলেস এলাকায় বাসটি থেকে যাত্রীর জন্য ডাকাডাকি করল। কিন্তু সেখানে কোনো ওয়েবিল নেই।

বাসটির একটি ওয়েবিল আগারগাঁওয়ে, পরেরটি গুলশানে। অর্থাৎ কেউ মহাখালী নামলেও তাকে ভাড়া মেটাতে হচ্ছে গুলশান পর্যন্ত।

বাসটিতে ভাড়া কাটা রফিকুল ইসলামের কাছে কেন এত জায়গায় থামানোর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যাত্রী তো উঠব-নামবই।’

যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওয়েবিল আসলে যাত্রীদের সঙ্গে মালিকদের প্রতারণার একটি কৌশল। হেলপার ও চালকরা যাতে টাকা আত্মসাৎ করতে না পারে, সে জন্য মালিকরা এই পদ্ধতি চালু করেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল পরে নৈরাজ্যের হাতিয়ার হয়ে গেল এই ওয়েবিল। সরকার থেকে ভাড়া নির্ধারণ করার পরও যাত্রীদের কাছ থেকে এই ওয়েবিলের কথা বলে বেশি ভাড়া আদায় করা হয়েছে গত কয়েক বছরে।’

তিনি বলেন, ‘প্রতি কিলোমিটার ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়া আছে। তাহলে একজন যাত্রী কেন ৩ কিলোমিটার গিয়ে ৮ কিলোমিটারের ভাড়া দিচ্ছেন।’

এ বিভাগের আরো খবর