বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মামলায় দেরি হলে ধর্ষণের বিচারের পথ রুদ্ধ?

  •    
  • ১২ নভেম্বর, ২০২১ ১৯:৫৩

‘অনেক মামলা আছে, যেটা ৭২ ঘণ্টা তো পরের কথা, এক বছর, দুই বছর পরও মামলা হয়। যখন ধর্ষণ একটা মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে, তখন হঠাৎ করে এমন একটি পর্যবেক্ষণ নারীর জন্য খুবই অবমাননাকর।’

ধর্ষণের শিকার হওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মেডিক্যাল টেস্ট করা না হলে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না, উল্লেখ করে এ সময়ের পরে ধর্ষণের মামলা না নিতে নির্দেশ দিয়েছে বিচারিক আদালত। কিন্তু এ রায়ের পরে প্রশ্ন উঠেছে, ধর্ষণের মামলায় বিলম্ব কি বিচারের পথ রুদ্ধ করে দিতে পারে?

আলোচিত রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার রায়ে বৃহস্পতিবার ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহার এ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। এ রায়ের পর আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে সর্বত্র।

রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখে কড়া সমালোচনা করেছেন মানবাধিকার সংগঠনসহ নারী নেত্রীরা। ৭২ ঘণ্টা পর হলে মামলা না নেয়ার নির্দেশকে নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে তুলনা করেছেন তারা। তবে এ ব্যাপারে মন্তব্য চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ের লিখিত কপি না দেখে তিনি মন্তব্য করবেন না।

এ রায়ের পর্যবেক্ষণের কঠোর সমালোচনা করেছেন মহিলা পরিষদের সভাপতি ড. ফওজিয়া মোসলেম। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘৭২ ঘণ্টার পর ধর্ষণ মামলা নেয়া যাবে না এমনটি কখনও দেখিনি। বরং বলা আছে, ধর্ষণের মামলা যেকোনো সময় করা যাবে।’

তিনি বলেন, ‘অনেক মামলা আছে, যেটা ৭২ ঘণ্টা তো পরের কথা, এক বছর, দুই বছর পরও মামলা হয়। যখন ধর্ষণ একটা মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে, তখন হঠাৎ করে এমন একটি পর্যবেক্ষণ নারীর জন্য খুবই অবমাননাকর।’

৭২ ঘণ্টার পর মামলা নেয়া যাবে না এমন কথা বলে বিচার পাওয়ার অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে জানিয়ে ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘এটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো একটি কথা। সবারই বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আমি যদি বিচার চাওয়ারই সুযোগ না পাই, তাহলে সেটা তো আমার অধিকার লঙ্ঘন হবে।’

তিনি বলেন, ‘ধর্ষণ মামলায় মেডিক্যাল রিপোর্টের ওপর প্রমাণ না হলে সামগ্রিক পরিস্থিতি ও আলামতের ওপর গুরুত্ব দেয়া হবে। সুতরাং এখানে ৭২ ঘণ্টার বিষয়টি আসে বলে মনে হয় না। এর ফলে এ ধরনের সহিংস অপরাধকে খাটো করে দেখার চেষ্টা হচ্ছে।’

রায়ের পর্যবেক্ষণের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘রায়ে বলা হয়েছে তারা “অভ্যাসগত”। এখন কথা হলো, অভ্যাসগত হলেই কি ধর্ষণের বিচার হবে না? যৌন মিলনে অভ্যস্ত হলে কেউ যে ধর্ষণের শিকার হবেন না, এটা বলা যাবে না। এ ধরনের কথা উচ্চ আদালতের নির্দেশনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ধর্ষণ মামলা প্রমাণ নাও হতে পারে। তাই বলে “অভ্যাসগত” বলে ধর্ষণের শিকার হবে না, এমনটি হতে পারে না। এ ধরনের পর্যবেক্ষণ যথাযথ বলে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে না।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘৭২ ঘণ্টার পরে মামলা নেয়া যাবে না, এমনটি তিনি (বিচারক) যদি বলে থাকেন, তাহলেও সেটি গ্রহণযোগ্য হবে না। তার কারণ হলো ধর্ষণের মামলা নিয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, ধর্ষণের অভিযোগ কেউ যদি করে আর সেখানে যদি আলামত নাও থাকে, তাহলে সামগ্রিক পরিস্থিতির আলোকে বিবেচনা করতে হবে। সুতরাং এটা তিনি (বিচারক) বলতে পারেন না।’

এ আইনজীবী বলেন, ‘ধর্ষণ মামলায় মেডিক্যাল রিপোর্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য এভিডেন্সও (সাক্ষ্যসাবুদ) নিতে হবে। এ ছাড়া এসব এভিডেন্সের মধ্যে ডিএনএ টেস্টও করতে পারত। শুধু মেডিক্যাল রিপোর্ট নয়, ডিএনএ টেস্ট নিতে পারত।’’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিচারক কী পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, কোন পরিপ্রেক্ষিতে দিয়েছেন, সেটি না পড়ে তো মন্তব্য করা ঠিক না। বিচারক মুখে যেটা বলছেন আর লিখিত যেটা থাকে, তার সঙ্গে অনেক সময় পার্থক্য থাকে। সে কারণে রায়টি না দেখে মন্তব্য করা ঠিক না।

‘তবে নারী নির্যাতন দমন আইন নিয়ে আমাদের আইন কমিশনে একটা ড্রাফট আছে, যেটা গত বছর ডিসেম্বর মাসে আইন মন্ত্রণালয়কে পাঠিয়েছি। সেখানে ধর্ষণজনিত মামলাগুলো কী করা উচিত, কীভাবে করা উচিত, তার একটা ধারণাপত্র আছে। সেখানে সব কিছু বলা আছে।’

এ বিষয়ে আইনমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘রায় পুরোটা না পড়ে বলব না। এটা ঠিক হবে না।’

ধর্ষণ মামলার মেডিক্যাল রিপোর্টের বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ডা. সালমা আক্তার মুনমুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রায়ে কী বলা হয়েছে জানি না, তবে ধর্ষণের ঘটনায় যত তাড়াতাড়ি ভিকটিমকে পরীক্ষার জন্য নেয়া যায়, তত ভালো। দেরি হয়ে গেলে আলামত নষ্ট হয়ে যায়। দেরি করলে আলামত থাকে না। ৭২ ঘণ্টা পরে যদি নেয়া হয়, তাহলে বিষয়টি হালকা হয়ে যায়। ধর্ষণের শিকার হলে যত দ্রুত সম্ভব মেডিক্যাল পরীক্ষা করানো উচিত। সেটা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হলে বেশি ভালো।’

রায়ের পর্যবেক্ষণ যা বলা হয়েছে

আলোচিত রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলায় সব আসামিকে খালাস দিয়ে রায় দেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহার।

রায়ে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে করা না হলে ধর্ষণ মামলা না নেয়ার নির্দেশ দিয়ে পর্যবেক্ষণ দেয় আদালত।

আদালত রায়ে বলে, ‘আক্রান্ত হওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মেডিক্যাল টেস্ট করা না হলে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না। তাই ৭২ ঘণ্টার বেশি হলে ধর্ষণের মামলা না নেয়ার জন্য বলেছে। কেননা তাতে মামলা প্রমাণ করা দুরূহ হয়ে পড়ে।’

আদালত নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ২২ ধারার বর্ণনা দিয়ে পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘মামলার বাদী নিজেকে অবিবাহিত বলে উল্লেখ করেন। তবে তার বয়ফ্রেন্ড আছে এবং তার সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে মেলামেশা হতো। অপর ভুক্তভোগী নিজেকে এনগেজড হিসেবে উল্লেখ করেন।

‘এই মামলায় ২০১৭ সালের ১ জুন আসামিদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন ঢাকা মেডিক্যালের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ডা. সোহেল মাহমুদ। সেই মেডিক্যাল রিপোর্টে বলা হয়েছে, কোনো ফোর্সফুল সেক্চুয়াল ইন্টারকোর্স (জোরপূর্বক যৌন সঙ্গম) আলামত পাওয়া যায়নি। তবে তারা যৌন সঙ্গমে অভ্যস্ত।’

মেডিক্যাল রিপোর্টের বরাত দিয়ে আদালত বলে, ‘এতে প্রমাণিত হয়, তারা রেগুলার শারীরিক সম্পর্ক পারফর্ম করে। তাই তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। মামলার আসামি সাদমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে ওই দুই তরুণীকে সাফাতের (মূল আসামি) সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। সাফাতের সাবেক স্ত্রী ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে (বাদী) এই মামলা করেছেন।’

বিচারক বলেন, ‘একসঙ্গে মদ্যপ অবস্থায় ড্যান্স করলেন, পরে এক বিছানায় চারজন মিলে শুয়ে থাকলেন, এখানে ধর্ষণ কীভাবে হলো? তারা ছিলেন উইলিংলি পার্টনার (স্বেচ্ছায় শয্যাসঙ্গী)। উত্তেজনাবশত শারীরিক সম্পর্ক করলে সেটা ধর্ষণ হয় কীভাবে? সেখানে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে, কিন্তু সেটা ধর্ষণ নয়। আর ওই হোটেলে অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করা যায় না বলে কর্মচারীরা সাক্ষ্যে বলেন। সুতরাং অস্ত্রের মুখে কীভাবে ধর্ষণের ঘটনা ঘটল?

‘আসামিরা ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আত্মপক্ষ সমর্থনে দেয়া বক্তব্যে বলেছেন, রিমান্ডে নিয়ে পুরুষাঙ্গে ইলেক্ট্রিক শকসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতন করে তাদের স্বীকারোক্তি নেয়া হয়েছে। তাদের ওই ১৬৪ ধারার জবানবন্দি প্রত্যাহারেরও আবেদন করা হয়েছে। পারিপার্শ্বিক বিবেচনায় আমার কাছেও তাই মনে হচ্ছে। তাই ওই ১৬৪ ধারার জবানবন্দিরকে এই রায়ে সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করতে পারছি না।’

এরপর আদালত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারার ব্যাখ্যা উল্লেখ করে বলেন, ‘যদি কোনো পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ষোল বৎসরের অধিক বয়সের কোনো নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া অথবা ১৬ বৎসরের কম বয়সের কোনো নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।

‘এখানে ধর্ষণের তিনটি উপাদান উল্লেখ রয়েছে, “সম্মতি ব্যতিরেকে”, “ভীতি প্রদর্শন” বা “প্রতারণামূলক সম্মতি আদায়” – কোনোটিই এই মামলায় বিদ্যমান নাই। ঘটনার ৩৮ দিন পর মামলা হলো, চিকিৎসক মেডিক্যাল রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত পাননি মর্মে মতামত দিলেন, ভুক্তভোগীরা পরিধেয় কাপড়ে কোনো পুরুষের সিমেনের কণা পাওয়া যায় নাই এবং আসামি নাঈম আশরাফের সঙ্গে ডিএনএ টেস্ট ম্যাচ করে নাই, তারপরও তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের (ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার) পরিদর্শক ইসমত আরা এমি চার্জশিট দাখিল করে আদালতের পাবলিক টাইম নষ্ট করেছেন। এতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রেপ কেসের বিচার ব্যাহত হয়েছে। তিনি অন্য কোনো পক্ষ কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে এই চার্জশিট দিয়ে মামলাটি বিচারের জন্য পাঠিয়েছেন। আজকের দিনসহ এই মামলায় ৯৪ কার্যদিবস ব্যয় হয়েছে।’

আদালত আরও বলেন, ‘২২/২৩ বছরের একজন লেডি এক বেডে চারজন একত্রে শুয়েছিল, মদ খেল, ড্যান্স করল এটা জেনেও অহেতুক এই প্রতিবেদন দিয়ে কোর্টের টাইম কনজিউম করল।

‘৭২ ঘণ্টার পর মেডিক্যাল টেস্ট করা হলেই ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না। তাই ৭২ ঘণ্টার বেশি হলে মামলা না নেয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে।’

এ বিভাগের আরো খবর