রাজশাহীর পবা উপজেলার হুজুরিপাড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা কুসুম। অদম্য ইচ্ছাশক্তির কারণে প্রতিবন্ধিতা তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেবা কেন্দ্রের (ইউডিসি) সহ-উদ্যোক্তা তিনি। এখানেই মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সেবা ‘নগদ’-এর (এজেন্ট) পয়েন্ট পরিচালনা করেন এই নারী।
নগদের নারী উদ্যোক্তা কুসুম বলেন, ‘প্রতিবন্ধী হওয়ায় সংসারে অভাব-অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। ভারী কোনো কাজ করতে পারতাম না। পরিস্থিতি বিবেচনা করে নগদ আমাকে উদ্যোক্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। এখন আমি ছেলে-মেয়ের পড়ালেখা চালানো ছাড়াও দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পারছি।’
ইউনিয়ন ডিজিটাল সেবা কেন্দ্রের উদ্যোক্তা জিয়াউল হক বলেন, ‘কুসুম নিজেও সরকারের প্রতিবন্ধী ভাতা নেন নগদের মাধ্যমে। আগ্রহ দেখেই তাকে উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি হতে সাহায্য করি। সে এখন কম্পিউটারের নানা কাজও করে।’
এই ইউডিসিতে বিধবা ভাতা নিতে আসা রোজিনা বেগম বলেন, ‘আগে ব্যাংকের মাধ্যমে বিধবা ভাতা নিতাম। সেখানে লাইনে দাঁড়াতে হতো। তা ছাড়া অনেক ঝামেলা পোহাতে হতো। এখন আমরা নগদের মাধ্যমে ভাতা নেই। এ জন্য আমাদের কোনো অসুবিধা হয় না। নগদ কোনো টাকাও কেটে রাখে না।’
শুধু পবার হুজুরিপাড়া নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রত্যন্ত গ্রামেও নগদের সেবা ছড়িয়ে পড়েছে। প্রান্তিক মানুষের জন্য আর্থিক খাতে ডিজিটাল সেবা নিশ্চিত করেছে ডাক বিভাগের এই মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সেবা। এটা গ্রামীণ মানুষের জীবনকে সহজ করেছে। সেবা বিতরণ থেকে শুরু করে এজেন্ট নিয়োগ পর্যন্ত পুরোটা ক্ষেত্রে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষকে দেয়া হয়েছে গুরুত্ব।
হুজুরিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে সেবা নিতে আসেন ৭৬ বছরের বৃদ্ধ আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকে লাইন দেয়ার দরকার নাই। শুক্র-শনিবার বা ছুটির দিন নাই। টাকা এলেই হাতে পাচ্ছি।’
কথাগুলো বলার সময় আনিসুর রহমানের চোখে-মুখে ছিল খুশির ঝিলিক।
আনিসুরের মতো সমাজের তিন কোটি পিছিয়ে পড়া মানুষকে গত এক বছরে সাড়ে আট কোটিবার সরকারের বিভিন্ন ভাতা ও অনুদান বিতরণ করেছে নগদ।
স্থানীয় ইউপির চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বলেন, দিন বদলে দেয়ার সেবা হয়ে এসেছে নগদ। এর মাধ্যমে এলাকায় নানা ভাতা দেয়া হচ্ছে। উপকারভোগীদের টাকা সরাসরি তাদের হাতে চলে যাচ্ছে। তারা ইচ্ছামতো সময়ে তা তুলে নিতে পারছে।
নগদের হেড অফ কমিউনিকেশন জাহিদুল ইসলাম সজল বলেন, ‘নগদ চালু হওয়ার মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনসহ বিল প্রদানসংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট খাতে দেশে ডিজিটাইজেশনের বিস্তার ঘটেছে। সরকারি এই সেবা একের পর এক উদ্ভাবন দিয়ে লেনদেনে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। এতে সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষটির জন্যও ডিজিটাল সেবার প্রসার ঘটেছে। তাদের জীবন-মানেরও পরিবর্তন হচ্ছে।
জাহিদুল ইসলাম বলেন, নগদই দেশের প্রথম প্রতিষ্ঠান, যারা গ্রাহক পরিচয় নিশ্চিত করতে ইলেকট্রনিক কেওয়াইসি (ই-কেওয়াইসি) ব্যবস্থা চালু করে। এর ফলে একদিকে গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট খোলার জটিল প্রক্রিয়া সহজতর হয়, অন্যদিকে অ্যাকাউন্ট খোলাসংক্রান্ত খরচও কমেছে। ফলে যাত্রা শুরুর মাত্র ৩২ মাসের মধ্যে ‘নগদ’-এর গ্রাহকসংখ্যা এখন সাড়ে পাঁচ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। নগদে দৈনিক গড়ে সাত শ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে।
নগদ জানায়, জাতীয় পরিচয়পত্রের দুদিকের ছবি তুলে অ্যাপের মাধ্যমে আপলোড করে অ্যাকাউন্ট খোলার পদ্ধতির নাম ই-কেওয়াইসি। এই পদ্ধতিতে যে কোনো মোবাইল ফোন থেকে *১৬৭# ডায়াল করে চার ডিজিটের পাসওয়ার্ড দিয়ে নগদের অ্যাকাউন্ট খোলা যায়। এই সেবার জন্য তথ্য-প্রযুক্তি খাতের বিশ্বকাপ খ্যাত উইটসা নগদকে সম্মাননা দিয়েছে।
নগদকে অনুসরণ করে দেশের অধিকাংশ ব্যাংক, এমএফএস ও অন্যান্য আর্থিক সেবা কোম্পানি ই-কেওয়াইসির মাধ্যমে গ্রাহক হিসাব খোলার পদ্ধতি চালু করে সাফল্য পাচ্ছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে নগদের মাধ্যমে সরকার তিন কোটি মানুষকে সাড়ে আট কোটিবার নানা ধরনের ভাতা, উপবৃত্তি ও অনুদান দিয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ের দেড় কোটি শিক্ষার্থীর মায়ের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে চারবার করে উপবৃত্তি বিতরণ করা হয়েছে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে উপবৃত্তি বিতরণে এমন ঘটনা সারা বিশ্বে প্রথম। নগদের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ৫৮ লাখ দুস্থ ও হতদরিদ্র ভাতা পেয়েছেন।
শুরু থেকেই ডাক বিভাগের এই মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসটি সেন্ড মানি বা টাকার লেনদেনকে ফ্রি করে দেয়। একইভাবে সব পরিষেবার বিল ফ্রিতে দেয়ার প্রচলন করে নগদ। বাজারে ক্যাশ-আউট চার্জ হাজারে ২০ টাকা হলেও নগদ এটি হাজারে ৯ টাকা ৯৯ পয়সায় (ভ্যাটসহ ১১ টাকা ৪৯ পয়সা) নামিয়ে আনে, যা গরিব মানুষকে বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। এতে গত এক বছরে প্রচলিত সেবার খরচের তুলনায় নগদের মাধ্যমে যারা সেবা নিয়েছেন তাদের এক হাজার কোটি টাকার বেশি সাশ্রয় হয়েছে।