সীমিত সামর্থ্য হলেও বিশ্বের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে অবদান রাখতে নিজের ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্যারিসে ইউনেসকো সদর দপ্তরে বৃহস্পতিবার ‘সৃজনশীল অর্থনীতি’র জন্য ‘ইউনেসকো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক পুরস্কার’ প্রদান অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘কয়েক দশক ধরে আমাদের দেশের উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সদয় সমর্থনকে আমরা বিনীতভাবে স্বীকার করি।
‘আমরা এখন আমাদের সীমিত সামর্থ্য দিয়ে বিশ্বসম্প্রদায়ের উন্নতির জন্য আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে অবদান রাখতে চাই।’
সৃজনশীল অর্থনীতিতে বিনিয়োগের ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি যে সৃজনশীল অর্থনীতিতে বিনিয়োগের ফলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সম্মিলিত লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে।’
প্রথমবারের মতো সৃজনশীল অর্থনীতির জন্য ইউনেসকো-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রদান করছে ইউনেসকো।
এ বছর সৃজনশীল অর্থনীতির জন্য বঙ্গবন্ধুর নামে ইউনেসকো পুরস্কার পেয়েছে উগান্ডার মোটিভ ক্রিয়েশন্স লিমিটেড।
সৃজনশীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে তরুণদের শিল্প উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে কর্মসূচি প্রণয়ন ও সহায়তার স্বীকৃতি হিসেবে বেসরকারি সংস্থ্যা উগান্ডার মোটিভ ক্রিয়েশন্স লিমিটেডকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়।
পুরস্কারের জন্য মনোনীত ৬৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে উগান্ডার কাম্পালার প্রতিষ্ঠান মোটিভ ক্রিয়েশন্স লিমিটেডকে বাছাই করা হয়। ইউনেসকোর স্বীকৃতি, সম্মাননার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি ৫০ হাজার ডলার পুরস্কার পাবে।
বঙ্গবন্ধুর নামে পুরস্কারটি সৃজনশীল অর্থনীতি বিকাশে অবদান রাখবে বলে আশা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, এই আন্তর্জাতিক পুরস্কার যা বৈশ্বিক অগ্রাধিকার অর্থাৎ লিঙ্গ সমতা এবং গোষ্ঠী হিসেবে যুবকদের অগ্রাধিকারে অবদান রেখে সৃজনশীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইউনেসকোর প্রচেষ্টাকে আরও বেগবান করবে।’
‘এ পুরস্কার অবশ্যই সৃজনশীল উদ্যোক্তা বিকাশের সর্বোত্তম অনুশীলনকে ধারণ, উদযাপন ও যোগাযোগের মাধ্যমে একটি জ্ঞান বিনিময়ের কৌশল তৈরি করবে।’
ইউনেসকোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘সৃজনশীল অর্থনীতির জন্য ইউনেসকো-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক পুরস্কার’ প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত বিশ্ব মানবতা ও শান্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের প্রতি সবচেয়ে উপযুক্ত সম্মান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণকে ইউনেসকো কর্তৃক স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টিও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ২০১৭ সালের ৩০-এ অক্টোবর ইউনেসকো জাতির পিতার ৭ই মার্চের ভাষণকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’-এ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে।
শিক্ষার প্রসার ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় সর্বোত্তম বিনিয়োগ এবং তিনি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক ঘোষণা করেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য-স্বাধীন দেশে নানা ধরনের অর্থনৈতিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও তিনি প্রায় ৩৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় দেড় লাখ শিক্ষক ও কর্মচারীর চাকরি জাতীয়করণ করেন। এই সাধারণ উদাহরণটিতেই শিক্ষাক্ষেত্রে এবং একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে তাঁর অগ্রাধিকারের বিষয়টি প্রতিফলিত হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তার সরকারও শিক্ষায় সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে।
টানা তিনবারের সরকারপ্রধান বলেন, 'আমরা দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছি। দেশে এখন প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৩৩ হাজার। এগুলোর মধ্যে ৬৫,৫৬৬টি সরকার পরিচালিত। ২০১০ সাল থেকে মাধ্যমিক স্কুলপর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হচ্ছে। এখন প্রতিবছর প্রায় ৪০ কোটি বই বিতরণ করা হয়। পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলোতে প্রায় ২৯ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বর্তমানে এক কোটি ৩ লাখেরও বেশি প্রাথমিক শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, 'দেশ-বিদেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএস, পিএইচডি ও পোস্ট-ডক্টরাল অধ্যয়ন ও গবেষণার জন্য আমরা ‘বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ’ চালু করেছি। এ পর্যন্ত প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৮০ জন স্কলারকে ফেলোশিপ দেয়া হয়েছে।'
উচ্চ শিক্ষার প্রসারে সরকারের কাজের কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, '২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশে ২০টি নতুন সরকারি প্রযুক্তি এবং সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি। বর্তমানে দেশে মোট সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫২। এ ছাড়া ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দেশে উচ্চশিক্ষা বিস্তারে নিয়োজিত আছে। বর্তমানে ৪৯২টি উপজেলায় কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হচ্ছে।'
সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া প্রতিরোধে ব্যাপক সহায়তা করেছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরে ছাত্র ভর্তির হার ৯৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০১৭ সালে স্কুলে ছেলে-মেয়ের অনুপাত বৃদ্ধি পেয়ে ৫৩:৪৭-এ দাঁড়িয়েছে, যা ২০০৯ সালে ছিল ৩৫:৬৫। ক্রমবর্ধমান হারে নারী শিক্ষা প্রসারের ফলে বাল্যবিয়ের হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।'