দেশে দ্বিতীয় দফায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তিন সপ্তাহের প্রচারে নজিরবিহীন নানা বক্তব্য দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী বা তার পক্ষের নেতারা।
কোনো এলাকায় তারা জনসভায় মাইকে ঘোষণা দিয়েছেন, ভোট দিতে হবে প্রকাশ্যে; কোথাও বলেছেন, নৌকা মার্কায় ভোট না দিলে কেন্দ্রে যাওয়ার দরকার নেই; আবার কোথাও বলেছেন, তাদের ভোট না দিলে এলাকায় কবর দিতেও দেয়া হবে না। একটি এলাকায় এক নেতা একে-৪৭-এর চেয়ে বড় কিছু নিয়ে আসার হুমকিও দিয়েছেন।
এসব ইউপিতে ভোট হয়েছে বৃহস্পতিবার। সেই তিন ইউপিতে ভোটেও বিশৃঙ্খলা দেখা গেছে। শুধু কিশোরগঞ্জে ভোট সুষ্ঠু হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। অন্য দুটিতেই সংঘর্ষ হয়ে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে। এ ছাড়া এজেন্টদের ঢুকতে না দেয়াসহ হুমকি-ধমকি দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নিউজবাংলার জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
কক্সবাজার: উখিয়ার হলদিয়াপালং ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকে ভোট না দিলে কবর দিতে দেয়া হবে না বলে হুমকি দিয়েছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী শাহ আলম।
এই বক্তব্য ভাইরাল হলে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী থানায় তার বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের লিখিত অভিযোগও করেন। নির্বাচন কমিশন থেকে বক্তব্যের ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠিও দেয়া হয়।
১ নভেম্বর রাতে ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মনির মার্কেট এলাকায় নিজের প্রচার অফিসের উদ্বোধন করে নৌকায় ভোট না দেয়ার পরিণতি সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেন প্রার্থী।
ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, শাহ আলম বলছেন, ‘কী অইবা? চিহ্নিত অইবা। হবরস্থান চৌধুরীপাড়া অইব দে। আইত ন পারিবা। আর হবরস্থানত আই হবর দিত ন দিয়্যুম। হবরস্থান আঁর, আঁই দিত ন দিয়্যুম এডে।’
প্রচারের সময় হুমকি দেয়া ওই ইউপিতে ভোটের দিনটি গেছে নানা বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতার মধ্য দিয়ে।
সকালে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট শুরু হলেও দুপুরে নলবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ব্যালট বক্স নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন নৌকার প্রার্থীর লোকজন।
এ নিয়ে নৌকার চেয়ারম্যান প্রার্থী শাহ আলম এবং দলের বিদ্রোহী প্রার্থী ঘোড়া প্রতীকের ইমরুল কায়েস চৌধুরীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ১২ জন আহত হন। স্থগিত করা হয় নলবনিয়া কেন্দ্রের ভোট।
ইউনিয়নের ৯টি কেন্দ্রে ভোটারদের সঙ্গে কথা বললে তারা অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ প্রার্থীর এজেন্টরা তাদের কাছ থেকে ব্যালট কেড়ে নিয়েছেন। পরে নিজেরাই নৌকায় ভোট দিয়ে দিয়েছেন।
তবে কক্সবাজারে দায়িত্বে থাকা র্যাব-১৫-এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর মেহেদী হাসান দাবি করেন, বিচ্ছিন্ন ও ছোটখাটো দু-একটি ঘটনা বাদ দিলে জেলার ২১টি ইউনিয়নেই শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম জানান, নির্বাচনে সহিংসতার অভিযোগে প্রায় ২০ জনকে পুলিশি হেফাজতে নেয়া হয়েছে। যাচাই-বাছাই করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কক্সবাজারের নির্বাচন কর্মকর্তা এ সএম শাহাদাত হোছাইন জানান, সহিংসতার কারণে খুরুশকুল তেতৈয়ার একটি এবং হলদিয়াপালংয়ে একটি কেন্দ্রে ভোট স্থগিত রাখা হয়েছে।
যশোরের ঝিকরগাছার একটি ভোটকেন্দ্র
কিশোরগঞ্জ: বাজিতপুর উপজেলার হুমাইপুর ইউনিয়নে নৌকার বাইরে কাউকে ভোট দিতে না দেয়ার হুমকি দেন উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা। নৌকাকে জেতাতে প্রয়োজনে একে-৪৭ অস্ত্রসহ সব ধরনের শক্তি খাটানোর হুমকিও দেন তিনি।
হুমকি দেয়া আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মামুন বাজিতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
৫ নভেম্বর বিকেলে বাজিতপুরের হুমাইপুর ইউনিয়নের টান গোসাইপুর গ্রামে হুমাইপুর ইসলামিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার মাঠে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় নৌকার চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী রফিকুল ইসলাম ধনু মিয়ার পক্ষে তিনি এ হুমকি দেন।
সেই জনসভার ৭ মিনিট ৯ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়।
বক্তব্যের শুরুতে তিনি বলেন, ‘আপনারা যারা মেম্বার পদপ্রার্থী হয়েছেন, আপনাদের কাউকেই নৌকার বাইরে ভোট দেয়ার সুযোগ দেয়া হবে না।’
মঞ্চের টেবিলটা দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘নৌকার ভোট হবে এই রকম টেবিলের ওপরে, ওপেন। আপনারা যারা বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে মেম্বার প্রার্থী হয়েছেন, আপনারা আপনাদের জয়ের চেষ্টা করে মেম্বার প্রার্থী হন, মহিলারা মহিলা মেম্বার প্রার্থী হন, আমাদের কোনো আপত্তি নাই।
‘আমাদের নেতা-কর্মীরা কোনো বাধা দেবে না। কিন্তু আপনাদের এজেন্টের বলে দিবেন নৌকার ভোট কোনো কাইত্ব্যের (গোপনে) ভেতরে হবে না, নৌকার ভোট হবে টেবিলের মধ্যে সবার সামনে। এখানে যদি কোনো মেম্বার প্রার্থী বা তাদের এজেন্ট বিরোধিতা করেন, আমরা তাৎক্ষণিক সেই প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেব।
‘আমরা সেদিন শুধু হুমাইপুরের শক্তি নিয়ে আসব না। আমাদের একে-৪৭ নাই, কিন্তু প্রয়োজনে সব নিয়ে আসব।’
ভোটের দিন অবশ্য তার বক্তব্য অনুযায়ী কোনো কর্মকাণ্ড চোখে পড়েনি। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই ভোট হয়েছে হুমাইপুর ইউনিয়নে।
হুমাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মানিক মিয়া নিউজবাংলাকে জানান, নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে তার কোনো অভিযোগ নেই। নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘শুধু আমি না, সারা ইউনিয়নের মানুষ দুশ্চিন্তায় ছিলেন, না জানি কী হয় ইলেকশনের দিন। তবে প্রশাসনের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের কারণে কেউ অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটাতে পারেনি।
‘জয়-পরাজয় বড় কথা না, নির্বাচনটা সুষ্ঠু হইছে দেখে মনে শান্তি পাইছি।’
আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়নাল আবেদীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আনারস প্রতীকে। তিনি বলেন, ‘পুরো ইউনিয়নে নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নাই। তবে ৫ নম্বর ওয়ার্ডের পঞ্চায়েত বাড়ির মক্তব কেন্দ্রের ফলাফল নিয়ে আশঙ্কা আছে।’
বাজিতপুর উপজেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর জানান, উপজেলার প্রতিটি কেন্দ্রে প্রশাসনের নজরদারি ছিল। কোথাও যেন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সে জন্য ম্যাজিস্ট্রেট, স্টাইকিং ফোর্সসহ পুলিশ, বিজিবি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মোতায়েন ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘অত্যন্ত সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন হয়েছে। শতকরা ৮০ ভাগ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন বলে আশা করা হচ্ছে।
যশোর: ঝিকরগাছা উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ভোট না দিলে ভোটের দিন কেন্দ্রে না গিয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে গরু-মুরগি খেতে যেতে বলেছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম।
সদর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আমির হোসেনের নির্বাচনি জনসভায় ৫ নভেম্বর তিনি বলেন, ‘নৌকা মার্কায় ভোট না দিলে ভোটের মাঠে আসার দরকার নেই এবং এলে প্রকাশ্যে নৌকায় সিল মারতে হবে। যদি নৌকায় ভোট না দেয়ার ইচ্ছা থাকে, তাইলে আত্মীয়ের বাড়ি গিয়ে মুরগি-গরু খান, শান্তিতে থাকেন।’
মনিরুলের এমন বক্তব্যের অডিও ক্লিপসহ যশোর জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ করেন ওই ইউপিতে আনারস প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল বারিক। তিনি যুবলীগের নেতা।
উপজেলা সদর ও বাঁকড়া ইউনিয়নে ভোটের দিনও সেই ঘোষণার কিছুটা ছাপ দেখা গেছে। দুই ইউপিতেই নিজেদের এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে না দেয়াসহ ভোটারদের হুমকি দেয়ার অভিযোগ তুলেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
একটি ইউপিতে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।
বাঁকড়ার খলসি কেন্দ্রে সকাল ৯টায় নৌকা ও মোটরসাইকেল প্রতীকের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। পরে পুলিশ এক রাউন্ড গুলি ছুড়লে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
৬ নম্বর ঝিকরগাছা ইউনিয়নে অবশ্য কোনো সংঘর্ষ হয়নি। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল বারিক অভিযোগ করেন, শ্রীরামপুর, লাউজানি ও দোস্তপুর কেন্দ্রে তার ভোটারদের হুমকি-ধমকি ও ভোট দিতে বাধা দেয়া হয়েছে।
বাঁকড়া ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী আনিছুর রহমান সকালে অভিযোগ করেন, সারা রাত মাঠশিয়া, খোসালনগর কেন্দ্রে বোমাবাজি করা হয়েছে বহিরাগত নিয়ে এসে। খলসী ও মাঠশিয়া কেন্দ্রে সকালে তার এজেন্টদের ঢুকতে দেয়া হয়নি। এক ঘণ্টা পর প্রশাসনের হস্তক্ষেপে তারা ঢুকতে পেরেছেন।
তবে পরে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হয়েছে বলে জানিয়েছেন আনিছুর রহমান।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি রাকিবুল হাসান রোকেল, যশোর প্রতিনিধি নিশাত বিজয় ও কক্সবাজার প্রতিনিধি সাকিবুর রহমান