সংঘর্ষ ও ছয় প্রাণহানির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে ৮৩৫টি ইউনিয়ন পরিষদের ভোট। সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়ে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোট হয়েছে এসব ইউনিয়নে। এখন চলছে গণনা।
ভোট চলাকালে নরসিংদীতে সংঘর্ষে প্রাণ গেছে তিনজনের। আর কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে নিহত হয়েছেন তিনজন।
দ্বিতীয় ধাপে ৮৪৮টি ইউনিয়নে ভোট হবে বলে গত ২৯ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। পরে তফসিল থেকে বাদ দেয়া হয় একটি ইউনিয়ন। আর নানা জটিলতায় নির্বাচন স্থগিত করা হয় সাতটি ইউনিয়নের ভোট। বাকিগুলোর মধ্যে পাঁচটিতে সব ধাপে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ায় ভোট হয়েছে ৮৩৫টি ইউনিয়নে।
সারা দেশে নিউজবাংলার প্রতিবেদকরা দিনভর নানা ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখেছেন। তারা জানিয়েছেন, বেশির ভাগ কেন্দ্রেই ভোটার উপস্থিতি ছিল ব্যাপক। ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই কেন্দ্রে এসেছেন বলে জানিয়েছেন।
ভোট শেষে কেন্দ্রে কেন্দ্রে চলছে গণনাএই নির্বাচনে প্রচার চলাকালে বেশ কিছু জেলায় সংঘর্ষ হয়েছে, প্রাণহানিও হয়েছে। এর মধ্যে নরসিংদীতে চারজন, মাগুরায় চারজন ও মেহেরপুরে দুজন নিহত হয়েছেন।
ভোটের দিনও সংঘর্ষ হয়েছে নরসিংদীতে। জেলার রায়পুরার বাঁশগাড়ি পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ মো. ইউসুফ নিউজবাংলাকে জানান, ভোট শুরুর আগে ইউপির কেন্দ্রগুলো দখলের চেষ্টা করেন নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকরা। এ নিয়ে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। একপর্যায়ে দা, টেঁটা নিয়ে তারা একে অপরের ওপর চড়াও হন। প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করতে গুলিও ছোড়া হয়।
এতে সালাউদ্দিন মিয়া, দুলাল মিয়া ও মো. জাহাঙ্গীর নামে তিনজন নিহত হন। তাদের মধ্যে সালাউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর বাঁশগাড়ি ইউনিয়নের স্বতন্ত্র প্রার্থী রাতুল হাসান জাকির সমর্থক বলে জানা গেছে। আর দুলাল বর্তমান চেয়ারম্যান ও নৌকার প্রার্থী আশরাফুল হকের সমর্থক। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন।
রায়পুরার চসুবুদ্ধি ইউনিয়নের মহিষবের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে হামলা, ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের অভিযোগে ভোট স্থগিত করা হয়েছে।
কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘অবস্থা খুবই খারাপ। শত শত লোক টেঁটা নিয়ে কেন্দ্রে হামলা করে ব্যালট বাক্স ও ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেয়। জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে কেন্দ্রটি স্থায়ীভাবে স্থগিত করা হয়েছে।’
নরসিংদীর রায়পুরার বাশঁগাড়ীতে কেন্দ্র দখলের জেরে হয় সংঘর্ষসহিংসতা হয় মেহেরপুরেও। জেলার মুজিবনগরের মহাজনপুর ইউনিয়নে নৌকা ও আনারস প্রার্থীর মধ্যে বাগবিতণ্ডার ঘটনায় পুলিশ ফাঁকা গুলি ছোড়ে। কোমরপুর ভোটকেন্দ্রে বেলা ১১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেন মুজিবনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাশেম।
তিনি জানান, কোমরপুর কেন্দ্রে নৌকার প্রার্থী রেজাউর রহমান নান্নু ও বিদ্রোহী প্রার্থী আনারস প্রতীকের আমাম হোসেন মিলুর সঙ্গে বাগযুদ্ধ শুরু হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ সেখানে ৪ রাউন্ড ফাঁকা গুলি চালায়।
এ ঘটনায় কোমরপুর কেন্দ্রে কিছুক্ষণ ভোট গ্রহণ বন্ধ রাখা হয়। আধা ঘণ্টা পর তা ফের চালু করা হয়।
এ ছাড়া মেহেরপুরের গাংনী থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গাংনী উপজেলার ভ্রমরদাহ কেন্দ্রে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে। তা ছাড়া বামন্দী ইউনিয়নের নিশিপুর গ্রামে দুই মেম্বার প্রার্থীর মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটলে পুলিশ তা সঙ্গে সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ আনে।
মাগুরায় ভোট হয়েছে ১২টি ইউপিতে। কোনো কেন্দ্র থেকেই সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়নি। প্রচারের সময় সদর উপজেলার জগদল ইউনিয়ন পরিষদে সহিংসতায় চারজন নিহত হয়েছিলেন। তবে ভোটের দিন সেখানকার কেন্দ্রগুলোতে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ভোটার এসেছেন। এর মধ্যে নারী ভোটারই বেশি দেখা গেছে।
মাগুরার জগদল ইউনিয়নে নারী ভোটারদের উপস্থিতি ছিল বেশিজগদল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা নিখিল চন্দ্র বিশ্বাস জানিয়েছেন, ৯০ শতাংশ ভোটারের মধ্যে নারীই ছিলেন বেশি।
কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুল ইউনিয়নে ভোট চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৬ জন। খুরুশকুল ইউনিয়নের তেতৈয়ায় বৃহস্পতিবার সকালে এ ঘটনা ঘটে। নিহত আকতারুজ্জামান খুরুশকুল ১ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থী (বর্তমান মেম্বার) শেখ কামালের ছোট ভাই।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে কক্সবাজার র্যাব-১৫-এর সিপিএসসি কমান্ডার মেজর মেহেদী হাসান জানান, ১ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থী বাবুলের সমর্থকরা ব্যালট পেপার আলাদা করে সিল মারার চেষ্টা করেন। এ সময় অপর মেম্বার প্রার্থী শেখ কামালের ভাই আকতারুজ্জামান বাধা দেন।
এ নিয়ে কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে আকতারুজ্জামানকে কোপানোর পর গুলি করা হয়। গুরুতর অবস্থায় প্রথমে তাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।
কক্সবাজারের খুরুশকুল ইউপি নির্বাচনে হামলায় আহতদের নেয়া হয় হাসপাতালেসহিংসতার ঘটনা ঘটেছে কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার মানিকারচর ইউনিয়নে। সেখানকার আমিরাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুপুর ১২টার দিকে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
নিহত শাওন আহমেদের বাড়ি মেঘনা উপজেলার বল্লবের কান্দি গ্রামে।
মেঘনা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক সালাউদ্দিন মোল্লা জানান, গুলিবিদ্ধ তিনজনকে হাসপাতালে নেয়ার পর একজনের মৃত্যু হয়। অন্যদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক।
স্থানীয়রা জানান, দুপুর ১২টার দিকে বহিরাগতরা আমিরাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করে। এ সময় বাধা দিলে তাদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
এ সময় পুলিশের গুলিতে জশ মিয়া, শাওন আহমেদ ও নাজমুল নামে তিনজন গুলিবিদ্ধ হন।
স্থানীয়রা আরও জানান, মানিকারচর জামে মসজিদের ইমাম নাজমুল হাসান মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেন যে ভোটকেন্দ্রে বহিরাগতরা প্রবেশ করে ভোট দিচ্ছে। এ ঘোষণার পরই উত্তেজনা শুরু হয়, যা পরে সংঘর্ষে গড়ায়। ওই ইমামকে আটক করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
ভোট চলাকালে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির লেলাং ইউনিয়নে দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকের সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন। ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের গোপালঘাটা আনন্দবাজার এলাকায় দুপুরে এই ঘটনা ঘটে। নিউজবাংলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফটিকছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রবিউল ইসলাম।
নিহত শফি উদ্দিনের বাড়ি গোপালঘাটায়। আনন্দবাজারে তার একটি বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের দোকান রয়েছে।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির লেলাং ইউনিয়নে দুই মেম্বার পদপ্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে শফি উদ্দিন নামের এক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেনফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দীন মুহুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শফি আমাদের খুবই আপন লোক এবং নির্দোষ একটা ছেলে। দুই পক্ষের সংঘর্ষে জড়িতদের শান্ত করার চেষ্টা করছিল সে। এর মাঝে পড়ে সেও ছুরিকাঘাতে আহত হয়। পরে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’
স্থানীয় আবুল কালাম বলেন, ‘লালপুল তোফায়েল আহমেদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষটি বাধে। ফুটবল প্রতীকের মুরাদ ও মোরগ প্রতীকের জামাল পাশার সমর্থকদের মধ্যে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।’
ভোট চলাকালে সংঘর্ষ হয়েছে সাতক্ষীরা, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, ফেনী, লালমনিরহাট, শরীয়তপুর, নারায়ণগঞ্জ, নোয়াখালী, যশোর ও শেরপুরে।