প্রতিবার বাস ভাড়া নির্ধারণের পর অতিরিক্ত আদায় নিয়ে গণমাধ্যমে শোরগোল হলেই মালিক-শ্রমিকদের নিয়ে আদালত বসিয়ে জরিমানা করেছে বিআরটিএ। কিন্তু এই অভিযান বেশিদিন চলে না, আর পরে বাড়তি ভাড়াটাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
এই জরিমানার অঙ্ক এক থেকে দুই হাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এমনও দেখা গেছে, জরিমানা দিয়ে পরের স্টপেজেই সেই পুরোনো অনিয়ম।
আবার অভিযান চালাতে বিআরটিএর হাতে ম্যাজিস্ট্রেট আছেন শুধু ১৩ জন। তাদের আবার ছুটিও থাকে। ফলে একসঙ্গে সবাইকে পাওয়াও যায় না। হাজার হাজার বাসের কতটি তারা পরীক্ষা করবে- এ নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।
এবারও ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর নতুন হারে ভাড়া নির্ধারণ করার পর অতিরিক্ত আদায়ের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়ার পরও সেই পুরোনো ঘোষণাই এসেছে। বাসমালিকদের সমিতি সড়ক পরিবহন মালিক সমিতিকে নিয়ে অভিযানে নামতে যাচ্ছে তারা।
বিআরটিএ রাজধানী ও আশপাশের জেলা থেকে রাজধানীতে আসা বাসের ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া নির্ধারণ করেছে বড় বাসে ২ টাকা ১৫ পয়সা আর মিনিবাসে ২ টাকা ৫ পয়সা। কিন্তু আগে থেকেই এর থেকে বেশি হারে আদায় করা বাসগুলো এখন আরও বেশি নিচ্ছে। নিউজবাংলা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে কোনো কোনো রুটে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া এখন ৪ টাকা ৭৬ পয়সা পর্যন্ত আছে।
যথারীতি গণমাধ্যমে আসার পর বিষয়গুলো নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে।
ছয় বছর আগে ২০১৫ সালে শেষবার যখন বাস ভাড়া নির্ধারণ করা হয়, সে সময়ও আগে থেকেই এর চেয়ে বেশি আদায় করা হতো। আর নতুন ভাড়ার নামে আদায় হতে থাকে আরও বেশি।
তার চেয়ে বেশি আদায়ে একপর্যায়ে চালু হয় সিটিং সার্ভিস নামে অননুমোদিত সার্ভিস। এ নিয়ে গণমাধ্যমে তোলপাড় হলে তখনও এবারের মতোই বাসমালিকদের নিয়ে অভিযানে নামে বিআরটিএ। কয়েক দিন যেতে না যেতেই ফিরে আসে আগের নৈরাজ্য। আসনের অতিরিক্ত যাত্রী ওঠে, কিন্তু ভাড়া নেয়া হতে থাকে সিটিং সার্ভিসের।
এরপর আসে ওয়েবিল নামে আরেক পকেট কাটা সার্ভিস। এখানে কিলোমিটারের কোনো হিসাব নেই। একটি নির্দিষ্ট গন্তব্য থেকে আরেকটি গন্তব্য পর্যন্ত একটি নির্ধারিত ভাড়া ঠিক করে গোটা পথকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে ভাড়া তুলতে থাকে কোম্পানিগুলো।
ভাগগুলো এমনভাবে করা হয়, যেখানে যাত্রী নামে কমই। যেমন বিমানবন্দর রোডের বাসগুলো মিরপুর থেকে আসার পথে একটি ওয়েবিল ঠিক করা আছে জোয়ারসাহারার কিছু পরে। অথচ যাত্রী নামে ৪০০ গজ দূরের খিলক্ষেতে। কেউ যদি জোয়ারসাহারা পর্যন্ত যান, তাহলে তার ভাড়া ১০ টাকা কম। আর এরপর থেকে উত্তরা পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট ভাড়া।
আবার সাতরাস্তা দিয়ে মগবাজার হয়ে চলা বাসগুলো ওয়েবিল ঠিক করেছে সাতরাস্তার আগে বা পরে। অথচ যাত্রী বেশি ওঠানামা করে সেখান থেকে ৬০০ গজ দূরের মগবাজারে। কেউ যদি সাতরাস্তা না নেমে মগবাজার যেতে চায়, তাহলে এইটুকু পথের জন্য তার কাছ থেকে ভাড়া নেয়া হয় কোনো কোনো বাসে সায়দাবাদের, কোনো কোনো বাসে গুলিস্তানের।
যা বলছেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান
বিআরটিএ বাস ভাড়া নির্ধারণ নিয়ে পরিবহন মালিক সমিতির সঙ্গে বৈঠক করলেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় নিয়ে কখনও তাদের ডেকে জবাবদিহি করেনি। বাস কোম্পানির রুট পারমিট বাতিলের মতো কঠোর ব্যবস্থাও কখনও নেয়া হয়নি।
আগে ব্যর্থ পদ্ধতিতেই কেন আগাচ্ছেন- প্রশ্ন ছিল বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদারের কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, এবার তারা জরিমানা বেশি করবেন, আবার আগের চেয়ে কঠোর পদক্ষেপও থাকবে।
নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘আজকেও আমার সামনে সিটি সার্ভিসের একটি বাসকে বাড়তি ভাড়া নেয়ার কারণে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ওই বাসে সারা দিন ট্রিপ দিয়ে নিশ্চয়ই এত টাকা আয়ও হয় না।
‘এরপরও যদি এই পরিবহন বাড়তি ভাড়া নেয়, তাহলে ওই বাস আমরা ডাম্পিং করে দেব, আর রুট পারমিট বাতিল করে দেব। এবার আর কোনো ছাড় দেয়া হবে না।’
এ বিষয়ে মালিক-শ্রমিকদেরও কঠোর বার্তা দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবার আমরা মালিক-শ্রমিকদের স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি তারা যেন দেশের সব মালিক-শ্রমিকে জানিয়ে দেন এবার আর কোনো বিশৃঙ্খলা চলবে না। তারাও আমাদের সমর্থন করেছেন। মালিক-শ্রমিকরাও আমাদের সঙ্গে মাঠে থাকবেন।’
যাত্রীদের কাছ থেকেও তথ্য চাইছেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান। তিনি জানান, বিআরটিএর কল সেন্টারে (১৬১০৭) ফোন দিয়ে অভিযোগ করা যাবে অথবা লিখিত আকারেও অভিযোগ পাঠালেও তারা ব্যবস্থা নেবেন।
বাসমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা চাই না পরিবহন সেক্টরে আর কোনো অনিয়ম থাকুক। মালিক সমিতির পক্ষ থেকে ভিজিল্যান্স টিম তৈরি করে সারা ঢাকা শহরে মনিটর করা হবে। কোথাও কোনো অনিয়ম ধরা পড়লে মালিক সমিতিও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।’
যাত্রীকল্যাণ সমিতির সংশয়
যাত্রী অধিকার নিয়ে সোচ্চার সংগঠন বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পরিবহন খাতে সরকারের কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ নেই, এখানে মালিকপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা চলে।’
তিনি বলেন, ‘সরকার পরিবহন মালিকদের দাবির মুখে একটা ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েই বিআরটিএর দায়িত্ব শেষ। পরে আর কোনো তদারকি থাকে না। মালিকরা আন্দোলন করে একদফা ভাড়া বাড়ায়, পরে আবার নানা কৌশলে সেই ভাড়া থেকেও বেশি ভাড়া আদায় করে। এসব দেখার কেউ থাকে না।
‘আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, সরকার যখন বাসের ভাড়া বাড়ায় তখন সেটা কোনোভাবে কার্যকর হয় না। সব সময় বাস মালিক-চালকরা বিভিন্ন উপায়ে বাড়তি ভাড়া আদায় করে।‘
বিআরটিএ বাস ভাড়ার যে চার্ট দেয়, সেটিও যাত্রীরা সহজে বোঝে না বলে মনে করেন মোজাম্মেল। বলেন, ‘এই চার্ট দেখে সহজে বুঝার উপায় নেই কোথাকার ভাড়া কত। রুট অনুযায়ী তালিকায় বিভিন্ন গন্তব্যের দূরত্ব ও ভাড়া স্পষ্ট উল্লেখ থাকতে হবে।’