রাঙ্গামাটিতে কলেজছাত্রী পূর্ণিমা চাকমার মৃত্যুতে রাঙ্গামাটি মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
বুধবার সকালে পূর্ণিমার মামাতো ভাই পলাশ চাকমা রাঙ্গামাটির জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম ফারহানা ইয়াসমিনের আদালতে মামলাটি করেন।
তিন আসামি হলেন নিকেতা দেওয়ান, মল্লিকা দেওয়ান ও অঞ্জলি চাকমা ওরফে প্রকাশ গান্ধী। তাদের মধ্যে নিকেতাকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।
পূর্ণিমা চাকমা রাঙ্গামাটি সরকারি মহিলা কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন। তার বাড়ি জুরাছড়ি উপজেলার ৪ নম্বর দুমদুম্যা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বগাহালি এলাকায়। বাবার নাম সাধন চাকমা।
পড়ালেখার জন্য পূর্ণিমা রাঙ্গামাটি শহরের রাজবাড়ি এলাকার মল্লিকা দেওয়ানের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। ২৯ অক্টোবর দুপুরের দিকে অচেতন অবস্থায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয় রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসক পূর্ণিমাকে মৃত ঘোষণার পরপরই হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান তাকে নিয়ে যাওয়া বাড়ির মালিকের লোকজন।
পরে তারা পূর্ণিমার মৃত্যুকে কেউ আত্মহত্যা আবার কেউ স্ট্রোক বলে দাবি করেন। তাদের এমন অসংলগ্ন কথায় মৃত্যুর কারণ নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।
এ ছাড়া পূর্ণিমার বাবাকে বাড়ির মালিক এক লাখ টাকা দিতে চেয়েছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বাদীপক্ষের আইনজীবী বিবরণ চাকমা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মামলা করা হয়। বিকেলে আদালতের পেশকারের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে কি না এবং মামলার সুষ্ঠু তদন্ত করে আগামী ১০ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য রাঙ্গামাটি কোতোয়ালি থানার ওসিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’
তবে রাঙ্গামাটি কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কবির হোসেনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি।
মেয়ে হত্যার বিচার চান বাবা সাধন
পূর্ণিমার বাবা সাধন চাকমা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার মেয়ে আত্মহত্যা করেনি। সে কোনো অবস্থাতেই আত্মহত্যা করার মতো মেয়ে না। অন্য কোনোভাবেও সে মারা যায়নি। তাকে হত্যা করা হয়েছে।
‘কারণ সে সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল। ঘটনার আগের দিনও মেয়ের সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়েছে। আমার মেয়েকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমি মেয়ে হত্যার বিচার চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার মেয়ের স্বপ্ন ছিল একজন চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করা। সে জন্য সেই দুর্গম এলাকা থেকে এসে রাঙ্গামাটি সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা করছিল সে।
‘আমাদের গ্রাম থেকে শহরে যাওয়া-আসায় সময় লাগে চার দিন। এসব কষ্ট স্বীকার করে আমার মেয়ে শহরে এসে পড়ালেখা করছিল। অথচ খুনিরা আজ মেয়ের স্বপ্ন শেষ করে দিল।’
স্বজনদের দাবি পূর্ণিমার গলায় নেই ফাঁসের গোলাকার চিহ্ন
বাড়ির মালিকের পক্ষ থেকে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার দাবি করা হলেও পূর্ণিমার স্বজনরা জানিয়েছেন, তার গলায় আঘাতের চিহ্ন থাকলেও তা ফাঁসের গোলাকার নয়।
পূর্ণিমার স্বজন ক্ষুদিরাম চাকমা বলেন, ‘যেদিন পূর্ণিমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেদিন ঘটনার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক আমি হাসপাতালে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি পূর্ণিমার নিথর দেহ একলা পড়ে আছে।
‘লাশের দেহে আত্মহত্যার কোনো আলামতও ছিল না। শুধু গলার সামনে জঘন্য আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। বাসার মালিকের পক্ষে সিলিং ফ্যানে ওড়না জড়িয়ে পূর্ণিমা আত্মহত্যা করেছে বলা হলেও তা সম্পূর্ণ মিথ্যা, কারণ গলায় ফাঁসের কোনো গোলাকার চিহ্ন নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাসায় যে রুমে পূর্ণিমা আত্মহত্যা করেছে বলা হয়েছে, সেখানে গিয়ে দেখা যায় সিলিং ফ্যান লাগানো আছে অনেক উঁচুতে। পূর্ণিমা নিজে কীভাবে সিলিং ফ্যানে গলায় ওড়না পেঁচিয়েছে, তার কোনো রকম আলামতও নেই।
‘তাই আমরা নিশ্চিত যে, নিষ্পাপ পূর্ণিমাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তা ছাড়া তারা নির্দোষ হলে তাহলে কেন পালিয়ে গেল?’
সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি স্বজন ও কলেজশিক্ষার্থীদের
পূর্ণিমাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগ এনে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করে ফাঁসির দাবি জানিয়েছে তার পরিবার, স্বজন ও কলেজের শিক্ষার্থীরা।
তারা অভিযোগ করেন, পূর্ণিমা হত্যার ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে আত্মহত্যা বলে চালোনোর অপচেষ্টা করা হচ্ছে। এ ছাড়া নানাভাবে দফারফার চেষ্টা করছে খুনিরা। পূর্ণিমার বাবাকে ১ লাখ টাকার বেশি ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে বাড়ির মালিক মল্লিকার পরিবার।
পূর্ণিমা যদি আত্মহত্যা করে থাকে, তাহলে টাকা দিয়ে কেন রফার চেষ্টা করছে বাড়ির মালিক, সেই প্রশ্ন তাদের।
পূর্ণিমার কয়েকজন সহপাঠী জানান, মালিকের সঙ্গে সমস্যার কারণে অনেক দিন ধরেই বাসা পাল্টানোর কথা তাদের বলে আসছিলেন পূর্ণিমা।
তবে এ বিষয়ে জানতে বারবার চেষ্টা করেও আসামি মল্লিকা বা তার পরিবারের কোনো সদস্যের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।