বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে সরকারি পাঁচ ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের সত্যতা পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। তারা বলছে, প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন এবং ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা আহ্ছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে।
গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, কয়েকটি সরকারি ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা মিলে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পরীক্ষার্থীদের কাছে ৫-১৫ লাখ টাকায় বিক্রি করেন। আগেভাগে যাদের প্রশ্নপত্র দেয়ার জন্য চুক্তিভুক্ত করা হয়, তাদের ‘গোপন বুথে’ নিয়ে প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করানো হয়। টাকা নিয়ে প্রশ্নপত্র পেয়েছে এমন ২ শতাধিক পরীক্ষার্থীর তালিকা পাওয়া গেছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর এসব তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে ডিবি পুলিশের তেজগাঁও বিভাগ। গ্রেপ্তার পাঁচজন হলেন মোক্তারুজ্জামান রয়েল, শামসুল হক শ্যামল, জানে আলম মিলন, মোস্তাফিজুর রহামান মিনল ও রাইসুল ইসলাম স্বপন। তাদের তিনজন বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকে কর্মরত।
ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে বুধবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ডিবিপ্রধান এ কে এম হাফিজ আক্তার। তিনি বলেন, ‘গত ৬ থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে এই পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। চক্রের আরও সদস্য রয়েছে। তাদেরও গ্রেপ্তারে ডিবির অভিযান চলছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির আওতায় ৬ নভেম্বর বিকেলে রাজধানীর বিভিন্ন কেন্দ্রে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকে অফিসার (ক্যাশ) নিয়োগের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ১ হাজার ৫১১টি পদের বিপরীতে এ পরীক্ষায় অংশ নেন ১ লাখ ১৬ হাজার ৪২৭ জন চাকরিপ্রত্যাশী।
এর মধ্যে সোনালী ব্যাংক ১৮৩টি, জনতা ব্যাংক ৫১৬, অগ্রণী ব্যাংক ৫০০, রূপালী ব্যাংক ৫ এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে ৭টি পদ রয়েছে।
পরীক্ষার পরপরই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। একাধিক চাকরিপ্রার্থীর দাবি, পরীক্ষা চলাকালীনই প্রশ্নের প্রিন্ট করা উত্তরপত্র ফেসবুকে পাওয়া যায়।
পরীক্ষা বাতিলের দাবি জানিয়ে পরের দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে স্মারকলিপি দেয় এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের একটি দল।
স্মারকলিপিতে পরীক্ষার্থীরা জানান, ৬ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত পরীক্ষা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে হয়েছে। পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর পরীক্ষা শুরুর আগেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া যায়।
পরীক্ষার্থীরা আরও অভিযোগ করেন, বিভিন্ন কেন্দ্রে পরীক্ষার সময় শেষ হওয়ার পরেও পরীক্ষা দিতে দেয়া হয়েছে। পরীক্ষায় পর্যবেক্ষক কম ছিল। কেন্দ্রে কেন্দ্রে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পৌঁছাতে দেরি হয়েছে।
এ ছাড়া নানা অব্যবস্থাপনা ও চরম অনিয়ম ছিল বলে স্মারকলিপিতে উল্লেখ করেন পরীক্ষার্থীরা। ওই পরীক্ষা বাতিলসহ দ্রুত নতুন করে পরীক্ষা নেয়ার দাবি জানান তারা।
তখন ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সদস্য ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হুমায়ুন কবির সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগের বিষয়টি আমরাও শুনেছি। ৪৬টি কেন্দ্রে পরীক্ষা হয়েছে। যদি প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় বা সংশ্লিষ্ট কেউ যদি জড়িত থাকে, তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেব।’
ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম আহ্ছানউল্লা ইউনিভার্সিটির আইসিটি টেকনিশিয়ান মোক্তারুজ্জামান রয়েল। এ ছাড়া তার সঙ্গে থেকে কাজ করেছেন জনতা ব্যাংকের গুলশান শাখার অফিসার শামসুল হক শ্যামল, রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার জানে আলম মিলন, পূবালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান মিলন ও রাইসুল ইসলাম স্বপন।
চক্রটি কয়েকটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে অন্তত ৬০ কোটি টাকা লেনদেন করেছে বলে জানতে পেরেছে ডিবি।
গ্রেপ্তার পাঁচজনের বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগও তদন্ত করা হচ্ছে। প্রমাণ পেলে মানি লন্ডারিং আইনেও মামলা হবে বলে জানিয়েছে ডিবিপ্রধান।
পরীক্ষার্থীবেশে চক্রে ঢোকে ডিবি
ব্রিফিংয়ে বলা হয়, দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে কাজ করতে থাকা ডিবির তেজগাঁও বিভাগের তেজগাঁও জোনাল টিমের কাছে গত ৫ নভেম্বর রাতে এই পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হবে মর্মে তথ্য আসে। এরপর চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের অনুসন্ধানী টিমের সঙ্গে ডিবির টিমটি একজনকে পরীক্ষার্থী সাজিয়ে পরীক্ষার দিন ৬ নভেম্বর সকাল ৭টায় প্রশ্নপত্রসহ উত্তর পাওয়ার জন্য চক্রের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা রাইসুল ইসলাম স্বপনকে অগ্রিম টাকা পরিশোধ করা হলে তারা পরীক্ষার্থীকে বুঝে নিয়ে যান। এরপর পরীক্ষার উত্তরপত্রসহ স্বপনকে হাতেনাতে আটক করা হয়।
গত ৬ নভেম্বর পরীক্ষায় আসা প্রশ্নের সঙ্গে সকালে পাওয়া প্রশ্ন ও উত্তর হুবহু মিলে গেলে স্বপনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে রূপালী ব্যাংকের সাভার শাখার শ্রীনগর থেকে জানে আলম মিলনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার জানে আলম মিলনের তথ্যের ভিত্তিতে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে অভিযান পরিচালনা করে জানা যায়, প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র সরবরাহকারী শামসুল হক শ্যামল ঢাকায় অবস্থান করছেন। পরে ঢাকার দক্ষিণ বাড্ডা থেকে শ্যামলকে গ্রেপ্তার করা হয়।
শ্যামলকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে প্রশ্নপত্রসহ উত্তরপত্র ফাঁস করার কথা স্বীকার করেন। তার দেয়া তথ্যে চক্রের মূল হোতা মুক্তারুজ্জামান রয়েলকে বাড্ডার আলিফনগর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মুক্তারুজ্জামান আহ্ছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে আইসিটি টেকনিশিয়ান (হ্যার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার) হিসেবে কর্মরত আছেন।
ডিবি বলছে, মুক্তারুজ্জামান আহ্ছানউল্লায় কর্মরত অন্য সহযোগীদের সহায়তায় পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তরপত্র সংগ্রহ করেছেন বলে স্বীকার করেছেন।
গ্রেপ্তারকৃতদের মোবাইল ফোনে থাকা তথ্য এবং হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর লালবাগ থেকে প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা পূবালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান মিলনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ব্রিফিংয়ে ডিবিপ্রধান হাফিজ আক্তার জানান, পরীক্ষার আগে চক্রের সদস্যরা রাজধানীর বাড্ডা, বসুন্ধরা, উত্তরা, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, রূপনগর, মিরপুর, মাতুয়াইল, শেওড়াপাড়া, শেরেবাংলা নগর, পল্লবী এলাকায় বুথ বসায়। সেখানে পরীক্ষার ৫-৬ ঘণ্টা আগে নিজস্ব লোকের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের ফাঁস করা প্রশ্ন ও উত্তরপত্র মুখস্থ করানো হয়। চক্রের সদস্যদের তত্ত্বাবাধনে প্রতিটি বুথে ২০-৩০ জন পরীক্ষার্থীকে উক্ত পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর মুখস্থ করিয়ে কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে গ্রেপ্তার ৫ জন। ছবি: সংগৃহীতআগেও ৩ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস
গ্রেপ্তার মুক্তারুজ্জামান ও শ্যামলের বরাতে ডিবি জানায়, সুকৌশলে তারা এর আগে বিভিন্ন নিয়োগের আরও তিনটি পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর ফাঁস করেছেন।
শ্যামল জানান, এই চক্র পরীক্ষার ৫-৬ ঘণ্টা আগেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে প্রায় ২ হাজার পরীক্ষার্থীদের মাঝে উক্ত পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর সরবরাহ করেছে। প্রত্যেক পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিয়োগ পাওয়ার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে ৫ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়।
এমসিকিউ পরীক্ষার আগে ২০ শতাংশ, লিখিত পরীক্ষার আগে আরও ২০ শতাংশ ও নিয়োগ পাওয়ার পর বাকি ৬০ শতাংশ টাকা পরিশোধের শর্তে পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে চুক্তি করে ডেকে নেয়া হতো।
ডিবিপ্রধান বলেন, ‘আমরা এ পর্যন্ত ১১টি বুথ এই চক্রের ২৫-৩০ জনের নাম এবং প্রায় ২০০ জন পরীক্ষার্থীর নাম পেয়েছি। মুক্তারুজ্জামান রয়েল প্রশ্ন ও উত্তর ফাঁসের মূল হোতা। মুক্তারের কাছ থেকে প্রশ্ন নিয়ে শামসুল হক শ্যামল বিভিন্ন বুথে সরবরাহ করেন। জানে আলম মিলন বিভিন্ন পরীক্ষার্থী সংগ্রহ ও বুথ নিয়ন্ত্রণ করেন। পরীক্ষার্থীদের প্রশ্ন ও উত্তর মুখস্থ করান।
‘অর্থের মাধ্যমে প্রশ্ন ও উত্তর প্রদান করেন। মোস্তাফিজুর রহমান মিলন পরীক্ষার্থী এবং বুথ নিয়ন্ত্রণ করেন। পরীক্ষার্থীদের প্রশ্ন ও উত্তর মুখস্থ করান। অর্থের মাধ্যমে প্রশ্ন ও উত্তর প্রদান করেন। স্বপন পরীক্ষার্থী; তিনিও প্রশ্ন ও উত্তরপত্র সংগ্রহ এবং বুথ নিয়ন্ত্রণ করেন। অর্থের মাধ্যমে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ও উত্তর প্রদান করেন। এ পর্যন্ত এই চক্রের শনাক্ত সদস্য সংখ্যা ২৫-৩০ জন বলে জানা গেছ। বিগত সময়ে অনুষ্ঠিত ব্যাংকের তিনটি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন তারা ফাঁস করেছিলেন বলে তথ্য মিলেছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে ডিবিপ্রধান বলেন, এই প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সঙ্গে আহ্ছানউল্লাসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই চক্রে আর যারা জড়িত, তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলমান রয়েছে।
অভিযোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংক দাবি করেছিল প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি, কিন্তু অভিযানে প্রমাণিত হচ্ছে যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে এই নিয়োগ পরীক্ষাসহ বিগত তিনটি পরীক্ষার নিয়োগ-প্রক্রিয়া বাতিলের সুপারিশ ডিবি করবে কি না, জানতে চাওয়া হয় হাফিজ আক্তারের কাছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রশ্নপত্র ফাঁসের তথ্য জানিয়েছি। তারা পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।’