টানা পতনের মধ্যে থাকা পুঁজিবাজারে পরপর দুই দিনের উত্থানে বিনিয়োগকারীদের মনের চাপ কাটল অনেকটাই।
সপ্তাহের দুই কর্মদিবসে সূচক এক শর বেশি পয়েন্ট পড়ে যাওয়ায় তৈরি হওয়া উৎকণ্ঠার মধ্যে মঙ্গলবারই ৬৮ পয়েন্ট বৃদ্ধির দিন কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে পেয়েছিলেন বিনিয়োগকারীরা। পরদিন তা বাড়ল ১১৪ পয়েন্ট।
দুই দিনে সূচকের ১৮২ পয়েন্ট উত্থান বিনিয়োগকারীদের মনে চিড় ধরা আত্মবিশ্বাস অনেকটাই ফিরিয়ে আনবে।
এক দিনে বেড়েছে ৩০১টি কোম্পানির শেয়ার দর। ক্রমেই নিম্নমুখী লেনদেনেও কিছুটা হলেও গতি এসেছে। অর্থাৎ বাড়তি দামেও শেয়ার কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
গত বছরের জুন থেকে পুঁজিবাজারে যে উত্থান দেখা দেয়, তাতে ৯ সেপ্টেম্বর থেকে সূচক বাড়ে সাড়ে তিন হাজার পয়েন্টের বেশি। এই পুরোটা সময় যে টানা উত্থান হয়েছে, এমন নয়। জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত টানা বাড়ার পর ওই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সংশোধনে সূচক কমে সাড়ে আট শ পয়েন্ট।
এরপর ৫ এপ্রিল থেকে ৩০ মে পর্যন্ত আরেক দফা উত্থানে সূচক বাড়ে এক হাজার পয়েন্টের মতো। এরপর এক মাসে একই বৃত্তে ঘুরপাক খেয়ে জুনের শেষ থেকে সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত আরেক দফা উত্থানে সূচক বাড়ে এক হাজার পয়েন্টের বেশি।
১২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া সংশোধনে বেশির ভাগ কোম্পানি দর হারালেও বড় মূলধনি কিছু কোম্পানির উত্থানের কারণে সূচকে প্রভাবটা দেখা যায়নি এক মাস। কিন্তু অক্টোবরের শেষ সময় থেকে বড় মূলধনি কোম্পানিগুলোও দর হারাতে থাকলে সূচক পড়ে যায় ৫০০ পয়েন্টে বেশি। আর এতে তৈরি হয় আতঙ্ক।
এর মধ্যে টানা সাত দিন সূচকের পতনে যে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়, তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি অংশীজনদের নিয়ে বসে। এরপর টানা চারদিন সূচকের উত্থান হলেও গত সপ্তাহ এবং চলতি সপ্তাহের দুই দিনে সাত কর্মদিবসের ৬ দিন বড় পতনে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ওঠেন বিনিয়োগকারীরা।
এর মধ্যে সূচকের পাশাপাশি লেনদেনও কমতে কমতে এক হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি নেমে আসে।
দর সংশোধন আর কত দিন চলবে, এই প্রশ্নের মধ্যে মঙ্গলবার ঘুরে দাঁড়ানো পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারীদের ততটা আস্থা দিতে পারেনি এ কারণে যে, পতনের মধ্যে এ ধরনের উত্থান প্রায়ই দেখা যায়।
তবে বুধবারের পরিস্থিতিটা একেবারেই ভিন্ন। দিনটা শুরুই হয় ৪০ পয়েন্টের বেশি সূচক বেড়ে। শেয়ার দর বৃদ্ধির হারও ছিল ভালো।
দুই ঘণ্টা পর দুপুর ১২টায় সূচক আগের দিনের চেয়ে ১১০ পয়েন্ট বেড়ে লেনদেন হতে থাকে। এরপর কিছুটা কমলেও শেষ বেলায় আরেক দফা বাড়ে।
দিন শেষে সূচকের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৯৮২ পয়েন্ট। আর লেনদেন দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৬৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।
পুঁজিবাজারে টানা দরপতনের মধ্যে এই উত্থান বিনিয়োগকারীদেরকে অনেকটাই স্বস্তি দেবে
পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা আবু আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এতদিন সূচক পতনের কারণে সিংহভাগ কোম্পানির শেয়ার দর কমেছে। একই সঙ্গে সেসব কোম্পানির শেয়ার বিনিয়োগ সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। দীর্ঘ একটি পতনের পর এমন উত্থান হওয়াটা স্বাভাবিক।’
সূচকের উত্থানে প্রধান ভূমিকায় ছিল আইসিবির দর বৃদ্ধি। গত সেপ্টেম্বরের দর থেকে ৫০ টাকার বেশি হারিয়ে ফেলা কোম্পানিটির শেয়ার এক দিনেই বেড়েছে ৫.৫৭ শতাংশ। এতে সূচক বেড়েছে ৮.৬৩ পয়েন্ট।
এ ছাড়া ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ, বাজার সংশোধনের মধ্যেও দর বাড়া বেক্সিমকো লিমিটেড, স্কয়ার ফার্মা, লাফার্জ হোলসিম সিমেন্ট, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, রবি, বিকন ফার্মা ও বিএসআরএম লিমিটেডের দর বৃদ্ধি সূচকের উত্থানে ছিল প্রধান ভূমিকায়।
সূচকের বড় উত্থানে প্রধান ভূমিকায় ছিল এই ১০টি কোম্পানি
এই ১০টি কোম্পানিই সূচকে যোগ করেছে ৪৮.৯৩ পয়েন্ট।
এদিন সাতটি কোম্পানির দর ৯ শতাংশের বেশি, চারটির দর ৮ শতাংশের বেশি, তিনটির দর ৭ শতাংশের বেশি, ৯টির দর ৬ শতাংশের বেশি, ১৬টির দর ৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
৪ শতাংশের বেশি বেড়েছে ২৬টির দর, ৩ শতাংশের বেশি বেড়েছে আরও ৩৩টির দর।
অন্যদিকে লভ্যাংশ সমন্বয়ের কারণে শেয়ার দর কমা ডরিন পাওয়ার, ফরচুন সুজ, পূবালী ব্যাংক, এনআরবিসি, জেনেক্সিল ইনফোসিস, পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স, ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স, ব্যাংক এশিয়া ও হামিদ ফেব্রিক্সের শেয়ার দর কমায় সূচক কিছুটা কমেছে।
এই ১০টি কোম্পানি সূচক কমিয়েছে ৪.৪৭ পয়েন্ট।
সিমেন্ট, প্রকৌশল, আর্থিক, খাদ্য, জ্বালানি, বিমা, তথ্যপ্রযুক্তি, বিবিধ, ওষুধ ও রসায়ন, বস্ত্র, এমনকি মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতেও দর বেড়েছে। তবে উত্থানের এমন দিনেও ব্যাংকে দিনটি খুব একটি ভালো গেছে এমন নয়। শেয়ার দর বাড়লেও দর বৃদ্ধির হার ছিল খুবই কম।
ব্যাপক উত্থানেও পুঁজিবাজারে হতাশ হয়েছে এই কোম্পানিগুলোর শেয়ারধারীরা
লেনদেনে শীর্ষে যেগুলো
বুধবার লেনদেনে শীর্ষে ছিল বেক্সিমকো লিমিটেড। কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১৪৫ কোটি ২৭ লাখ টাকার। দর বেড়েছে ২.৪১ শতাংশ।
বেক্সিমকো গ্রুপের বেক্সিমকো ফার্মা মঙ্গলবার দেশের বাজারে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী অ্যান্টিভাইরাস ওরাল পিল বা মুখে খাওয়ার ওষুধ ‘এমোরিভির‘ বাজারজাত শুরু করেছে।
যার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে কোম্পানিটির শেয়ারে। কোম্পানিটিতে লেনদেন হয়েছে ৩১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। লেনদেনে শীর্ষ দশ কোম্পানির মধ্যে কোম্পানিটির অবস্থান ছিল চতুর্থ। লেনদেনে কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়েছে ১.৫২ শতাংশ।
লেনদেনে দ্বিতীয় স্থানে ছিল ওষুধ খাতের ওরিয়ন ফার্মা। কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়েছে ৫.২০ শতাংশ, লেনদেন হয়েছে মোট ৬১ কোটি ১৬ লাখ টাকা।
উত্থানের দিন লেনদেনের শীর্ষে উঠে এসেছে বস্ত্র খাত। এরপরই ছিল ওষুধ ও রসায়ন
লাফার্জ হোলসিম সিমেন্টের শেয়ার দর বেড়েছে ৩.২৭ শতাংশ। লেনদেন হয়েছে মোট ৪৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
ব্যাংক খাতের আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার ছিল লেনদেনর শীর্ষ পাঁচে। দর বৃদ্ধির হার ছিল ২.২০ শতাংশ। হাতবদল হয়েছে ১ কোটি ৪২ লাখ ৯৬ হাজার ২৮৪টি।
কাট্টালি টেক্সটাইলের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকার। আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ, ডেল্টা লাইফ, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, সাইফ পাওয়ারটেক ছিল সবচেয়ে বেশি লেনদেনের তালিকায়।
দর বৃদ্ধির শীর্ষ দশে যেগুলো
সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে তথ্য প্রযুক্তি খাতের এডিএন টেলিকমের। কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়েছে ৯.৭৯ শতাংশ। শেয়ার দর ৫৮ টাকা ২০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৩ টাকা ৯০ পয়সা। কোম্পানিটির মোট ৫ লাখ ২৭ হাজার ৮৫৫টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
দর বৃদ্ধির দ্বিতীয় স্থানে ছিল সদ্য লেনদেনে আসা সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্স। টানা চার দিন দিনের সর্বোচ্চ দামে লেনদেন হওয়া কোম্পানিটির শেয়ার দরে যোগ হয়েছে ৯.৭৭ শতাংশ। তবে লেনদেন হয়েছে কেবল ১ হাজার ২২০টি।
শেয়ারদর বাড়লেও লেনদেনে গতি ছিল না এই খাতগুলোতে
তৃতীয় অবস্থানে ছিল ইসলামী ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, যার শেয়ার প্রতি দর বেড়েছে ৯.৭১ শতাংশ।
ওষুধ খাতের এডভেন্ট ফার্মার দর ৯.৭০ শতাংশ, ডমিনেজ স্টিলের দর বেড়েছে ৯.৬৭ শতাংশ। এছাড়া এ তালিকায় ছিল আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ, আমান ফিড।
ব্যাংক বহির্ভুত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন ক্যাপিটালের শেয়ার দর ৮.৯১ শতাংশ, বিমা খাতের ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের দর ৮.৮১ শতাংশ, তুংহাই নিটিংয়ের দর বেড়েছে ৮.৪৭ শতাংশ।
দর পতনে থাকা শীর্ষ ১০
দরপতনের শীর্ষে ছিল মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতের ইবিএল ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড। এর দাম কমেছে ৩.৭৯ শতাংশ।
এ ছাড়া মেঘনা কনডেন্সড মিল্কের দর ৩.০৬ শতাংশ, হামিদ ফেব্রিক্সের দর ২.৯৪ শতাংশ, ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সের দর ২.৯০ শতাংশ কমেছে।
ইস্টার্ন ক্যাবল, ফরচুর সুজ, পদ্মা লাইফ, পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স ও জিবিবি পাওয়ার ছিল দরপতনের শীর্ষ তালিকায়।
এই তালিকার শীর্ষে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ডরিন পাওয়ারকে দেখালেও কোম্পানিটির ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার সমন্বয় হয়েছে। রেকর্ড ডেটে শেয়ারদর ছিল ৭৪.৮ টাকা। বোনাস সমন্বয়ে দাম দাঁড়ায় ৬৮ টাকা। দিন শেষে দাম দাঁড়ায় ৬৯ টাকা ১০ পয়সা।
অর্থাৎ সমন্বয়ের পর ১.৬১ শতাংশ দর বেড়েছে। কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি দেড় টাকা নগদ লভ্যাংশও দিয়েছে।