পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ দখল করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মার্কেট নির্মাণের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চললেও মাঠ উদ্ধারের জন্য উদ্যোগ নেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর অফিসসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি পাঠানোতেই আটকে আছে মাঠ উদ্ধারের প্রক্রিয়া।
ধূপখোলা মাঠ নামে পরিচিত প্রায় ২১ বিঘা আয়তনের এ মাঠের এক প্রান্তে মাটি খুঁড়ে পাইলিংসহ ঢালাইয়ের কাজ সম্পন্ন করেছে সিটি করপোরেশনের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। পুরো মাঠেই মাটি ও নির্মাণসামগ্রী স্তূপ করে রাখা। খেলার মাঠে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে বাণিজ্যিক ভবনের কাঠামো। খেলতে এসে মাঠের ভেতরে মাটি ও নির্মাণসামগ্রীর স্তূপ দেখে ফিরে যেতে হচ্ছে এলাকার শিশু-কিশোরদের।
গত ১০ জুন দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪৫ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শামসুজ্জোহা ও সিটি করপোরেশনের উপসহকারী প্রকৌশলী হরিদাস মল্লিক মাঠের ভেতর ম্যাপ অনুযায়ী চার কোনায় খুঁটি বসান। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে না জানিয়ে মাঠের মধ্যে মার্কেট নির্মাণের পরিকল্পনার বিষয়টি নজরে আসার পরপরই ক্ষোভ প্রকাশ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গেন্ডারিয়া থানায় একটি জিডি করে।
মাঠ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে আলোচনায় বসে। তবে মাঠ সংস্কার হলেও খেলতে পারবেন শিক্ষার্থীরা – এই আশ্বাসেই আশ্বস্ত হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
ধূপখোলা খেলার মাঠে উঠছে বহুতল বিপণিবিতান। ছবি: নিউজবাংলাপরে নির্মাণকাজ দ্রুতগতিতে এগোতে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়ার চিন্তা করে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বিভিন্ন মহলে চিঠি, বৈঠক আর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরও বন্ধ হয়নি মাঠ দখলের এ কার্যক্রম।
মাঠ উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ইমদাদুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘খেলার মাঠ নিয়ে ইতোমধ্যে আমরা মেয়রকে আবার চিঠি দিয়েছি, শিক্ষামন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছি, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি, প্রধানমন্ত্রীর অফিসে চিঠি দিয়েছি। তারপরেও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যায় কি না সে ব্যপারেও আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি।’
পুরোনো খেলার মাঠ উদ্ধারে তেমন তৎপরতা না থাকলেও নতুন মাঠ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন উপাচার্য। ঢাকার কেরানীগঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থায়নে কেনা সাত একর পাঁচ শতাংশ জমির একটি অংশে অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পসে খেলার মাঠ তৈরির পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
নতুন মাঠ তৈরির বিষয়ে উপাচার্য বলেন, ‘আমরা নিজেদের মাঠ নিজেরাই করতে প্ল্যান করছি। কেরানীগঞ্জে নতুন ক্যাম্পাস ছাড়াই আমাদের নিজস্ব কেনা যে জায়গাটা, ওখানে আমাদের ইতোমধ্যে জায়গা নির্ধারণ হয়ে গেছে। সীমানাপ্রাচীর হওয়ার পরপরই আমরা নিজেদের মাঠ নিজেরাই করে ফেলব। যত দ্রুত সম্ভব সেই চেষ্টা করছি। দরকার হলে আমরা গাড়ি দেব, খেলাধুলা করে আবার শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে চলে আসবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটাও হচ্ছে আমাদের একটা নতুন প্রচেষ্টা। আরেকটা হলো আমাদের ক্যাম্পাস যদি ওখানে যায়, তাহলে এখানে কেউ খেলতে আসবে না। এখানে মাঠের যে অবস্থা, খেলার মতো কোনো অবস্থাই নেই। তারপরেও আমরা ওই কাজগুলো করছি এবং আমরা আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখছি। সাথে সাথে আমরা নিজেদের জায়গায় নিজেরাই মাঠ করব, সেই পরিকল্পনা হয়ে গেছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার ও ক্রীড়া কমিটির আহবায়ক অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা চার জায়গায় চিঠি দিয়েছি। মেয়রকে আমরা আবারও চিঠি পাঠিয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর অফিস, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়েও চিঠি দিয়েছি। আমরা যেভাবে আগানোর দরকার সেভাবেই আগাব। আমরা চিঠি পাঠিয়ে জবাবের জন্য অপেক্ষা করছি।’
কেনা জমিতে মাঠ স্থাপনের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘ওখানে আমাদের এস্টেট শাখার কর্মকর্তা এবং ক্রীড়া কমিটির সদস্যসচিব গিয়েছিলেন। তারা মাঠ দেখে এসেছেন। তাদেরকে এ জন্যই পাঠানো হয়েছে যে মাঠ সম্পর্কে তাদের একটা ধারণা আছে, আর জায়গাটি মাঠ করার জন্য উপযোগী কি না। তারা বলেছে যে, জায়গাটি মাঠ করার জন্য শতভাগ উপযোগী। আমরাও বেশ কয়েকবার দেখতে গিয়েছিলাম। এক মাসের মধ্যেই মাঠ তৈরি করা সম্ভব। তার সঙ্গে ঘর তো লাগবে, সেখানে বসবে, কাপড়চোপড় পরিবর্তন করবে। তারপর টয়লেট, পানির ব্যবস্থা এগুলোও লাগবে।’
অল্প সময়ে কাজ করতে টেন্ডারের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এগুলো টেন্ডারের মাধ্যমে করা হবে। এটা ইমার্জেন্সি পদ্ধতিতে পার্ট বাই পার্ট করা যায়। সাডেন অ্যামাউন্ট করে আবার তার সাথে সমন্বয় করে আবার করা যায়। দ্রুত কাজ করার জন্য এই পদ্ধতিতে করা যায়। এখন হয়তো একটা ধাপে কিছু টাকা খরচ করল, সেটা সমন্বয় করে পরে আবার করা যায়।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া কমিটির সদস্যসচিব ও শরীরচর্চা কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক গৌতম কুমার দাস বলেন, ‘সিটি করপোরেশন নির্মাণকাজ অনেকটাই করে ফেলেছে। তারা আমাদের যেটা জানিয়েছে, সেটা হলো, কাজ শেষ হলে আমরা মাঠ ব্যবহার করতে পারব। আমাদের যখন প্রয়োজন হবে, তখন তাদের জানালে আমরা মাঠ ব্যবহারের অনুমতি পাব। আমরা সেটার আশায় তো আর থাকতে পারি না। সে জন্য কেরানীগঞ্জে আমাদের নিজস্ব কেনা জায়গায় উঁচু জায়গা সমান করে মাঠ হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করা হবে। ফেব্রুয়ারির মধ্যেই সেই কাজ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে।’
মাঠ উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মো. ওহিদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছি। এখনও চিঠির জবাব পাইনি।’
ওই মাঠের মালিকানারা ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে নথিপত্র না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা যেহেতু সরকারি প্রতিষ্ঠান। এসব নথিপত্র সরকারের কাছে রয়েছে।’
১৯৮৪ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীদের খেলার কোনো মাঠ না থাকায় পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় অবস্থিত ৭ একর আয়তনের মাঠটি তিন ভাগে ভাগ করে এক ভাগ তৎকালীন সরকারি জগন্নাথ কলেজকে ব্যবহারের মৌখিক অনুমতি দিয়েছিলেন। আর একটি অংশ ‘ইস্ট এন্ড খেলার মাঠ’ নামে একটি ক্লাবের কর্তৃত্বে রয়েছে। অপর অংশটি রাখা হয় জনসাধারণের খেলার জন্য।
বর্তমানে ধূপখোলা মাঠটি একটি মেগা প্রকল্পের আওতায় রয়েছে। মাঠটিতে নির্মাণ করা হবে একটি বহুতল বাণিজ্যিক ভবন, পাশে একটি খেলার মাঠ, হাঁটার জন্য রাস্তা, ক্যাফেটরিয়া ও পার্কিং লট। এরই মধ্যে প্রকল্পের প্রাথমিক নির্মাণকাজ শুরু করে দিয়েছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। খেলার মাঠ দখল করে মার্কেট নির্মাণ প্রকল্প শুরু করায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ এলাকাবাসী এ নিয়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছে। শিক্ষার্থীরা কয়েক দফা মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশও করেছে।