বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হয় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক। রপ্তানির এ ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে খাতসংশ্লিষ্ট রপ্তানিকারকদের বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে নানারকম সেবা নিতে হয়।
প্রতি বছর নির্দিষ্ট মেয়াদে এই সেবা গ্রহণের জন্য ইপিবি থেকে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিবন্ধন গ্রহণ কিংবা মেয়াদ নবায়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
কিন্তু ইপিবির নিবন্ধন এবং নবায়ন প্রক্রিয়ায় নয়টি শর্ত রয়েছে, যার চারটিই অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয় বলে দাবি করেছে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।
দেশে ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া সহজীকরণের স্বার্থে সংস্থাটির আরোপিত অপ্রসাঙ্গিক ওইসব শর্ত প্রত্যাহার করে নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান এ এইচ এম আহসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা গতকাল এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পেয়েছি। তাদের প্রস্তাবটি আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখব। ইন হাউজ একটা মিটিং করতে হবে। যদি কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকে, তা হলে তাদের প্রস্তাবটি ব্যবসা সহজীকরণের স্বার্থে বিবেচনা করা হবে।’
রপ্তানি ও আমদানি কাজে ব্যস্ত চট্রগ্রাম বন্দর। ফাইল ছবি
২০২০-২১ অর্থবছর মেয়াদে ইপিবি সনদ পাওয়ার ক্ষেত্রে ৩ হাজার টাকা নবায়ন ফি এবং বিলম্বের ক্ষেত্রে আরও ২ হাজার টাকাসহ মোট ৫ হাজার টাকা ফি দেয়ার নিয়ম ছিল। একই সঙ্গে নিবন্ধন সনদ গ্রহণ বা নবায়নে রপ্তানিকারকদের নয়টি শর্ত পূরণ করতে হয়েছিল।
শর্তগুলো হচ্ছে: রপ্তানিকারককে আবেদন ফর্মের সঙ্গে সত্যায়িত দুই কপি ছবি প্রদান, ট্রেড লাইসেন্সের নবায়িত কপি, এক্সপোর্ট রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট (ইআরসি) লাইসেন্সের নবায়িত কপি, সংশ্লিষ্ট সমিতির সদস্য সনদের নবায়িত কপি, বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সের নবায়িত কপি (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), ফায়ার সার্ভিস সনদপত্রের নবায়িত কপি, ফায়ার পলিসির নবায়িত কপি, গ্রুপ বীমার নবায়িত কপি এবং যেসব প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত কারখানা ভবনের লে-আউট প্ল্যান ও স্ট্র্যাকচারাল ডিজাইনের কপি দাখিল করেনি, সেসব প্রতিষ্ঠানকে আবেদনপত্রের সঙ্গে বাধ্যতামূলক কারখানা ভবনের লে-আউট প্ল্যান ও স্ট্র্যাকচারাল ডিজাইনের কপি দাখিল করতে হবে।
এরপর নতুন কোনো সংস্কার না আসায় চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্যও খাতসংশ্লিষ্টদের ইপিবির নিবন্ধন সনদ গ্রহণ বা নবায়নে একই শর্ত পালন করতে হবে।
ইপিবির দেয়া এসব শর্তের বেশিরভাগকেই অপ্রসাঙ্গিক উল্লেখ করে গত রোববার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যানের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছে বিজিএমইএ।
সংগঠনের মহাসচিব মো. ফয়জুর রহমান স্বাক্ষরিত ওই চিঠির অনুলিপি সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েও পাঠানো হয়েছে।
চিঠিতে বিজিএমইএ-এর পক্ষ থেকে বলা হয়, বিদেশি ক্রেতার চাহিদার কারণে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকার স্বার্থে বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পসমূহ নিজ উদ্যোগেই কমপ্লায়েন্ট হতে বাধ্য হয়েছে।
কিন্তু ইপিবির জারিকৃত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, নিবন্ধন গ্রহণ ও নবায়নের ক্ষেত্রে মোট নয় ধরনের নথি দাখিল করতে হয়।
এর মধ্যে কারখানা ভবনের অনুমোদিত লে-আউট প্ল্যান ও স্ট্র্যাকচারাল ডিজাইন, বন্ডেড ওয়্যার হাউসের লাইসেন্সের নবায়িত কপি, ফায়ার পলিসির নবায়িত কপি, গ্রুপ বিমার নবায়িত কপি – এ জাতীয় ডকুমেন্ট প্রাপ্তির সাথে ইপিবির সেবার কোনো সম্পর্ক নেই।
ব্যবসা প্রক্রিয়া সহজীকরণের প্রসঙ্গে টেনে চিঠিতে বলা হয়, ব্যবসায় সহজীকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৬৮তম অবস্থানে আছে। ব্যবসা সহজীকরণ প্রক্রিয়ায় এমন তলানি অবস্থান দেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগসহ দেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে।
এমন পরিস্থিতিতে দেশের রপ্তানি এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে বাধাহীন ও নিরবচ্ছিন্নভাবে রপ্তানি কার্যক্রম চালাতে পারে, সে লক্ষ্যে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সেবা প্রাপ্তিকে আরও সহজ করতে হবে। এ লক্ষ্যে সনদ প্রদান বা নবায়নের স্বার্থে যেসব ডকুমেন্ট একান্ত আবশ্যক, কেবলমাত্র সেগুলো রেখে অন্যান্য ডকুমেন্ট প্রদানের বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহার করা হোক।
বিজিএমইএ-এর যুক্তি
একটি কারখানা ভবনে লে-আউট প্ল্যান ও স্ট্র্যাকচারাল ডিজাইন পর্যবেক্ষণ করেই অনুমোদন দেয়ার জন্য কারিগরী জ্ঞানসম্পন্ন সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর রয়েছে।
এ বিষয়ে ইপিবি ওইসব কাগজপত্র পর্যবেক্ষণের বিষয়টি পরিহার করতে পারে।
বন্ডেড ও নন-বন্ডেড উভয় ধরনের কারখানাকে ইপিবির নিবন্ধন নিতে হয় এবং উভয় ধরনের কারখানা রপ্তানির জন্য অনুমোদিত। তাই বন্ডেড ওয়ারহাউসের লাইসেন্সের নবায়িত কপি দাখিলের শর্ত বাদ দেয়া যায়।
অগ্নিকাণ্ড বা দুর্ঘটনা জাতীয় যে কোনো পরিস্থিতিতে কারখানার যন্ত্রপাতি বা মালামালের ক্ষতিপূরণের স্বার্থে কারখানা কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে যে কোনো বিমা কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে পারে। এটি কারখানা কর্তৃপক্ষের একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে সরকারিভাবে কোনো বাধবাধকতা নেই।
এ কারণে ইপিবির নিবন্ধন গ্রহণ বা নবায়নকালে ফায়ার পলিসির নবায়িত কপি দাখিলের শর্ত পরিহার করা যেতে পারে।
এ ছাড়া বর্তমানে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে গ্রুপ বিমার প্রচলন আর নেই। কারণ ইতিমধ্যে সরকারি আইন অনুসারে জুলাই ২০১৬ থেকে প্রতিটি এলসির বিপরীতে রপ্তানিমূল্য প্রত্যাবাসিত হওয়ার সাথে সাথে শূন্য দশমিক ০৩ হারে উৎস্য মূ্ল্য থেকে কেটে নিয়ে তা শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের নামে গঠিত তহবিলে জমা করা হয়, যা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন।
ওই তহবিল থেকে জানুয়ারি ২০১৭ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের আর্থিক অনুদান দেয়া হচ্ছে।
তাই এ বিষয়ে ইপিবিতে গ্রুপ বীমার নবায়িত কপি দাখিলের শর্ত বাদ দেয়া যেতে পারে।