বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ঢাকায় বর্ধিত বাস ভাড়ারও দ্বিগুণ আদায়

  •    
  • ৮ নভেম্বর, ২০২১ ২০:৫২

ডিজেলের দাম বাড়ার পর বাস ভাড়া কিলোমিটার প্রতি যত টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, ঢাকায় আগে থেকেই নেয়া হতে তার চেয়ে বেশি। এখন সেই বেশির ওপর আবার বেশি নেয়ার কারণে নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুণেরও বেশি আদায় হচ্ছে কোনো কোনো রুটে।

সিএনজি বা ডিজেলের বিতর্কে না গেলেও রাজধানীতে বাস ভাড়া বাড়িয়ে যে হারে নির্ধারণ করা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি হারে আগেই আদায় করছে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। এখন আরও বেশি আদায় করার পর সরকার নির্ধারিত হারের চেয়ে কোনো কোনো রুটে দ্বিগুণ, কোনো কোনো গন্তব্যে তিন গুণ আদায় করা হচ্ছে।

ডিজেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর পর বাসমালিকরা ধর্মঘটে গিয়ে চাপ দেয়ার পর দূরপাল্লায় ভাড়া কিলোমিটার প্রতি ১ টাকা ৪২ পয়সা থেকে ১ টাকা ৮০ পয়সা আর নগর পরিবহনে ১ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে বড় বাসে ২ টাকা ১৫ পয়সা ও মিনিবাসে ২ টাকা ৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়।

আগেই জানিয়ে দেয়া হয়, এই বর্ধিত ভাড়া কার্যকর হবে কেবল ডিজেলচালিত বাসের ক্ষেত্রে। সিএনজিচালিত বাসে তা কার্যকর হবে না।

কিন্তু দেখা গেছে, এখন সব বাসকে ডিজেলচালিত দাবি করে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। আর ভাড়া এতটাই বেশি নেয়া হচ্ছে, তাতে দেখা যায়, কিলেমিটার ২ টাকা পড়ছে না, ৪ টাকা বা তার চেয়ে বেশি পড়ে যাচ্ছে।

বর্ধিত বাসভাড়া নিয়ে যাত্রীরা প্রতিবাদ করছেন, তর্ক করছেন, কিন্তু সুবিধা করতে পারেননি। কারণ, পরিবহন শ্রমিকরা মানতে রাজি নয়। আর যেতেই হবে, সব বাসেই একই চিত্র, এ কারণে যাত্রীরাও মেনে নিয়েই ক্ষোভ ঝাড়ছেন মন্তব্যে।

এই অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের দিন সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত আদায় করা হলে কঠোর ব্যবস্থা নেবেন তারা।

কিন্তু এই ধরনের হুঁশিয়ারি বারবার দেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। কখনও কিছুই করা যায়নি। নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ এ বিষয়ে পরিবহন মালিকদের জবাবদিহির আওতায় আনতে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

যাত্রীদের পক্ষে সোচ্চার সংগঠন বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী এই প্রসঙ্গে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকার ভাড়া নির্ধারণ করেছে কিলোমিটার হিসাবে। আর ঢাকা মহানগরে সেটি আদায় করা হচ্ছে ওয়েবিল হিসাবে। যখন ওয়েবিল হিসেবে ভাড়া আদায় করা হয়, তখন কিলোমিটারের হিসাবে যায় না। ফলে আমি যদি ৫ কিলোমিটার পথে যাতায়াত করি, আমাকে কখনও ১০ কিলোমিটার পথের ভাড়া দিতে হয়। আর সেই ভাড়াও নির্ধারণ করা হয় দূরত্বের তুলনায় বেশি।’

নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আজকে আমি শাহবাগ থেকে সাইনবোর্ড আসার পথে রজনীগন্ধা পরিবহনে উঠলাম। শাহবাগ থেকে সাইনবোর্ডের দূরত্ব হলো ১৫ কিলোমিটার। সরকারের বর্ধিত ভাড়া অনুসারে ৩২ টাকা ভাড়া আসার কথা। যাওয়ার সময় ভাড়া নেয়া হয়েছে ৪৫ টাকা আবার আসার পথে ভাড়া নেয়া হয়েছে ৪০ টাকা। এটাই চিত্র রাজধানীজুড়ে, এটাই চিত্র দেশজুড়ে।’

তিনি বলেন, ‘ভাড়া নির্ধারণের সময় আমাদেরকে এই ধরনের কথাগুলো বলারও সুযোগ দেয়া হয়নি। আমাদেরকে বাদ দিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে বলে আমরা মনে করি।’

ঝগড়াঝাটি করেও বাড়তি ভাড়া পরিশোধ ছাড়া উপায় থাকছে না যাত্রীদের

অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ঠেকাতে না পারার বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘যাত্রীদের থেকে বাড়তি ভাড়া নিলে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আমিসহ ১০ জন ম্যাজিস্ট্রেট রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে দায়িত্ব পালন করছি। যাত্রীদের কাছ থেকে ঘোষিত ভাড়ার চেয়ে বাড়তি ভাড়া না নেয়া হয়, এ বিষয়টি তারা দেখছে।’

প্রতিবার যখন অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়, তখন বিআরটিএ এই পদ্ধতিতেই কাজ করে। কিন্তু কখনও তা বাড়তি ভাড়া আদায় ঠেকাতে পারেনি।

বিআরটিএ এর আগেও ভাড়া ঠিক করেছে, সেটি কখনও কার্যকর করতে পারেনি। নিউজবাংলা ঢাকা-কিশোরগঞ্জ রুটের বিভিন্ন গন্তব্যের ভাড়া হিসাব করে দেখেছে, নতুন যে হারে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি টাকা আগে থেকেই নেয়া হয়। এখন সেই বাড়তি টাকার চেয়ে বেশি আদায় করা হচ্ছে।

এভাবে ১০/১২ জন ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ঢাকা শহরের পয়েন্টে দাঁড়িয়ে বাড়তি ভাড়া আদায় ঠেকাতে না পারার প্রসঙ্গটি তুললে বিআরটিএ চেয়ারম্যান তোলেন জনবল সংকটের বিষয়টি।

তিনি বলেন, ‘আমরা চাইলেই সারা দেশে একযোগে মনিটরিং করতে পারব না। চট্টগ্রামে ৩ জন ও ঢাকাতে ১০, এই ১৩ জন ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে চলছে মনিটরিং।

নির্ধারিত হারের দ্বিগুণ আদায়

রাজধানীর সাতরাস্তা থেকে গুলিস্তানের দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটারেরও কম। বিআরটিএ বাস ভাড়া ২৬.৫ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়ার পরেও এই দূরত্বের ভাড়া হয় ১০ টাকা। কিন্তু অনাবিল পরিবহনে আগে থেকেই আদায় হতো ১৫ টাকা। এবার আদায় করা হচ্ছে ২০ টাকা।

৪ দশমিক ৬ কিলোমিটারের জন্য এই ভাড়া নেয়া হলে কিলোমিটার প্রতি পড়ে ৪ টাকা ৩৪ পয়সা।

কেউ যদি মগবাজার নামতে চায়, তাহলেও তার কাছ থেকে ২০ টাকাই আদায় করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে কিলোমিটার প্রতি ভাড়া পড়ে ১০ টাকার মতো। কারণ, এই পথটার দূরত্ব তখন হয় ২ কিলোমিটারের কিছুটা বেশি।

গন্তব্য স্বল্প দূরত্বের হলে অবশ্য ২ টাকা ১৫ বা ২ টাকা ৫ পয়সা কিলোমিটারের হিসাবটা আর খাটে না। তখন মিনিবাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ৮ টাকা আর বড় বাসে ১০ টাকার হিসাব পড়ার কথা। কিন্তু যেসব বাস সর্বনিম্ন ভাড়া আগে আদায় করত ১০ টাকা, তারা এখন নিচ্ছে ২০ টাকা।

এই ছয়টি রুটেও বাস ভাড়া নির্ধারিত বাস ভাড়ার প্রায় দ্বিগুণ

হাতিরঝিলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটারেরও কম। নতুন হারে এই পথে ভাড়া হয় ১০ টাকার কিছু বেশি। কিন্তু আগেই নেয়া হতো ১৫ টাকা, অর্থাৎ কিলোমিটারে তিন টাকা, এখন নেয়া হচ্ছে ২০ টাকা, অর্থাৎ কিলোমিটারে চার টাকা।

বৈশাখী পরিবহনে আগারগাঁও থেকে মহাখালী পর্যন্ত ৬.৮ কিলোমিটার দূরত্বে আগেই ভাড়া নেয়া হতো ২০ টাকা, অর্থাৎ কিলোমিটার প্রতি ৩ টাকা করে। সোমবার এই পথে ৩০ টাকা ভাড়া চাইতেই যাত্রীরা ক্ষেপে উঠেন। পরে ২৫ টাকা ভাড়া নেন শ্রমিকরা। অর্থাৎ কিলোমিটারে ভাড়া পড়ে ৩ টাকা ৬৭ পয়সা।

একই বাসে আগারগাঁও থেকে বাড্ডা পর্যন্ত দূরত্ব হয় ১০.২ কিলোমিটার। আগে ভাড়া নেয়া হতো ৩০ টাকা। এখন নেয়া হচ্ছে ৪০ টাকা। অর্থাৎ কিলোমিটারে প্রায় চার টাকা।

শ্যামলীর শিশুমেলা থেকে এস এম লাভলী পরিবহনে উঠেছেন পারভেজ আহমেদ। যাবেন কমলাপুর। ভাড়া তুলছিলেন ইসহাক মিয়া। তিনি চাইলেন ৪৫ টাকা।

দুজনের মধ্যে ঝগড়া বাধল। যাত্রী পারভেজ বলছেন, ‘কথা এত টাকা বাড়ছে কীভাবে। ৩০ টাকা ছিল।’

কিন্তু ইসহাক মিয়া বলেন, ‘আগে ৩৫ টাকা আছিল। আপনি, সব্বাইরে জিগান। আমি ক্যা বেশি ভাড়া নিমু?’

উপস্থিত অন্যরাও জানালেন, ১০ টাকা ভাড়া বাড়িয়েছে। তবুও পারভেজ আহমেদ বলতে থাকলেন, ‘এরা সুযোগ পাইলেই বেশি ভাড়া নেয়। আর আজকে তো আরও বেশি সুযোগ পাইছে।’

পরে অবশ্য ৪৫ টাকাই দিলেন পারভেজ।

এই পথের দূরত্ব ৯ দশমিক ৪ কিলোমিটার। ৪৫ টাকা ভাড়া আদায় হলে প্রতি কিলোমিটারে পড়ে ৪ টাকা ৭৮ পয়সা।

কেউ যদি পল্টন বা গুলিস্তানও নামতে চান, তাহলে দূরত্ব দুই কিলোমিটার কমে গেলেও ভাড়া তাকে একই দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া ঠিক হয় কিলোমিটারে ৬ টাকার বেশি।

খিলক্ষেত থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত দূরত্ব হয় ১৪.৫ কিলোমিটার। নতুন হারে ভাড়া হয় ৩০ টাকা। কিন্তু ভিক্টর পরিবহনে এই পরিমাণ টাকা আগেই আদায় করা হতো, এখন আরও বাড়িয়ে নেয়া হচ্ছে ৪০ টাকা।

একই বাসে গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পর্যন্ত ৩.৩ কিলোমিটারের জন্য আগে ভাড়া নেয়া হতো ১০ টাকা। এখন তা নেয়া হচ্ছে ১৫ টাকা। অর্থাৎ আগে থেকেই বর্তমান হারের চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করা হতো। এখন নেয়া হচ্ছে আরও বেশি।

ফার্মগেট থেকে মিরপুর ১০ পর্যন্ত পথের দূরত্ব ৬.৪ কিলোমিটার। আগে থেকেই ভাড়া নেয়া হতো ১৫ টাকা, এখন তা আরও বাড়িয়ে ২০ টাকা করা হয়েছে।

ফার্মগেট থেকে শ্যাওড়াপাড়া পর্যন্ত দূরত্ব ৪.৩ কিলোমিটার। আর ফার্মগেট থেকে মিরপুর-১২ পর্যন্ত দূরত্ব ৮.৭ কিলোমিটার। কিন্তু পুরো পথেরই ভাড়া আদায় করা হচ্ছে একই।

আসলে ফার্মগেট থেকে মিরপুর-১২ পর্যন্ত দূরত্বের ভিত্তিতে ভাড়া নির্ধারণ করে আদায় করা হচ্ছে পথের পুরোটার জন্য।

খিলক্ষেত থেকে বনানীর কাকলী মোড় পর্যন্ত ৫.৫ কিলোমিটার দূরতে আগে কোনো বাস নিত ১০ টাকা, কোনো বাস ১৫ টাকা। যেসব বাস এতদিন ১০ টাকা নিত, তারা এখন আদায় করছে ১৫ টাকা, যেসব বাস নিত ১৫ টাকা, তারা আদায় করছে ২০ টাকা।

সোহেল আহমেদ নামে একজন মনজিল পরিবহনে এই পথ পাড়ি দেন। তিনি বলেন, ‘হেলপার ২০ টাকা চাইছিল। আমি ১৫ টাকা দিয়েছি। কিন্তু সে ২০ টাকাই আদায় করার চেষ্টা করেছে।’

বিস্ময়কর হচ্ছে, একই বাসে সোহেলকে ফেরার পথে ভাড়া দিতে হয়েছে ১০ টাকা বেশি। আগে এই পথে ভাড়া নিত ২০ টাকা, সেটি এবার বাড়িয়ে করা হয়েছে ২৫ টাকা।

এই বাসটি যায় আবদুল্লাহপুরের কামারপাড়া পর্যন্ত। কাকলী থেকে যেখানেই যাত্রী নামুক না কেন, তাকে পুরো পথের ভাড়াই দিতে হয়। এখানে কিলোমিটারের কোনো হিসাব নেই।

মোহাম্মদ মাসুদ বাংলামটর থেকে এস এম লাভলী পরিবহনে উঠেছেন। তার সেলুন মৌচাকে। মগবাজার ফ্লাইওভার পার হওয়ার পর বাস কনট্রাকটার ইসহাক মিয়া ১৫ টাকা ভাড়া চাইতেই তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘এইটুকু রাস্তা ১৫ টাকা! দেশটাই মগের মুল্লুক হয়ে গেছে।’

এ বিভাগের আরো খবর