কর্মসূচিতে অংশ না নেয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদা সূর্যসেন হলের দুই ছাত্রকে মারধর ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠছে ছাত্রলীগের দুই কর্মীর বিরুদ্ধে।
হলের ৩৫১ নম্বর কক্ষে রোববার রাত পৌনে তিনটা থেকে ভোররাত চারটা পর্যন্ত এ নির্যাতন চলে বলে দাবি করেন দুই ছাত্র। এ কক্ষেই থাকেন ছাত্রলীগের অভিযুক্ত দুই কর্মী।
অভিযোগকারী শিক্ষার্থীরা হলেন নৃবিজ্ঞান বিভাগের আরিফুল ইসলাম এবং থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের তরিকুল ইসলাম। তাদের মধ্যে আরিফুল সূর্যসেন হল সংসদের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। তিনি ও তরিকুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র।
অভিযুক্ত দুই ছাত্রলীগকর্মী হলেন উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সিফাত উল্লাহ সিফাত এবং আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের ইংলিশ ফর স্পিকার্স অব আদার ল্যাঙ্গুয়েজেস বিভাগের মাহমুদুর রহমান অর্পণ।
নির্যাতনের কারণে ২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয় এ দুই ছাত্রকে। ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন।
অভিযুক্ত দুই শিক্ষার্থী হল ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এবং ক্যাম্পাসে হল ছাত্রলীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক ইমরান সাগরের ছোট ভাই বলে পরিচিত।
ইমরান সাগর ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের অনুসারী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের ২০১৫-২০১৬ সেশনের ছাত্র।
কী বলছেন অভিযোগকারী শিক্ষার্থীরা
অভিযোগকারী শিক্ষার্থীরা জানান, ঘটনার সময় ৩৫১ নম্বর কক্ষে ছাত্রলীগের দুই কর্মীর সঙ্গে তাদের আরও চার বন্ধু উপস্থিত ছিলেন। তারা হলেন চতুর্থ বর্ষের ছাত্র শাকিল, রেজওয়ান, তাসকিন ও মারুফ। এদের মধ্যে শাকিল উর্দু বিভাগের আর রেজওয়ান ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের।
ঘটনার বিষয়ে অভিযোগকারী আরিফুল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি এবং তরিকুল বেশ কিছুদিন ধরে ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম এবং গেস্ট রুমে অনিয়মিত হয়ে যাই। এসবের জন্য তারা (অভিযুক্ত) আমাদের ডাকলেও পরীক্ষা বা ক্লাস থাকার কারণে আমরা আসতাম না। এ নিয়ে তারা আমাদের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল।
‘তারা আমাদের হল থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টা করলেও আমাদের রুমটা প্রশাসনের মাধ্যমে বরাদ্দ হওয়ায় সেটি পারেননি। সর্বশেষ গতকালের ঘটনা ঘটান।’
ঘটনার বিষয়ে এ শিক্ষার্থী বলেন, ‘গতকাল রাতে আমি এবং বন্ধু তরিকুল রুমে ঘুমাচ্ছি। রাত আড়াইটার দিকে সিফাত উল্লাহ এবং মাহমুদ অর্পণ রুমে আসেন। আমাদের তাদের ৩৫১ নম্বর রুমে ডেকে নিয়ে যান। সেখানে আগে থেকেই ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের আরও চারজন উপস্থিত ছিলেন। এরপর তারা শুরুতে তাদের সাথে বেয়াদবি করেছি বলে আমাদের বকা দিতে থাকেন।
‘একপর্যায়ে সিফাত এবং মাহমুদ উত্তেজিত হয়ে যান। আমাদের দিকে রড, স্টাম্প নিয়ে তেড়ে আসেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত তাদের বাকি বন্ধুরা এই দুইজনকে ধরে রাখার চেষ্টা করে। এরপর তারা রড স্ট্যাম্প ফেলে দিয়ে আমাদেরকে কিল-ঘুষি মারতে থাকেন।’
‘ইনহেলার নিতে হবে জানালেও ছাড়েনি’
অভিযোগকারী আরিফুল বলেন, ‘একপর্যায়ে আমাদেরকে দেয়ালের সাথে গলা চেপে ধরেন সিফাত এবং মাহমুদ। আমার অ্যাজমা সমস্যা থাকার কারণে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ইনহেলার নিতে হবে জানালেও তারা আমাকে ছাড়েনি। এরপর আমি অসুস্থ হয়ে রুমেই শুয়ে পড়ি। এ সময় তারা আমাদের মা-বাবাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে।
‘চারটার সময় আমাদের রুম থেকে ছেড়ে দেয়। যাওয়ার সময় আজ (সোমবার) দুপুর ১২টার মধ্যে হল থেকে বের হয়ে না গেলে হত্যা করে হলের পানির ট্যাংকের পিছনে ফেলে দেবে বলেও হুমকি দেয়। ভয়ে আমরা রাতেই হল থেকে বের হয়ে যাই।’
আরিফ আরও বলেন, “আমাদের যখন রুম থেকে ডেকে নেয়া হচ্ছে, তখন আমি হল ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী ইমরান সাগর ভাইকে ফোন দিলে তিনি বলেন, ‘যাও, দেখো তারা কী বলে।’ অভিযুক্তরাও বলে, তারা ইমরান ভাইকে জানিয়েই আমাদের রুমে এসেছেন। এর থেকে ধারণা করছি আমাদের মারধরের ব্যাপারে ইমরান সাগর ভাইয়ের নির্দেশ ছিল।”
অন্য ভুক্তভোগী তরিকুল ইসলামও নিউজবাংলাকে ঘটনার বর্ণনা দেন। তার বর্ণনার সঙ্গে আরিফের বর্ণনা হুবহু মিলে যায়। তাদের কাছে ঘটনার সম্পূর্ণ অডিও রেকর্ড আছে বলেও জানান তরিকুল।
তরিকুল বলেন, ‘আমরা যখন তাদের রুম থেকে বের হচ্ছি শ্বাসকষ্টের কারণে বন্ধু আসিফের অবস্থা খারাপ ছিল। তাকে এক রকম টেনে টেনেই রুমে নিয়ে এসেছি। এরপর আমরা হল থেকে বের হয়ে যাই।
‘সে সময় আমরা প্রক্টর (অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রাব্বানী) স্যারকে ফোন দিই। খুব ভোর হওয়ায় হয়তো তিনি ফোন রিসিভ করতে পারেননি। এরপর ঘটনার বিষয়ে বিস্তারিত লিখে মেসেজ দিই। তবে তিনি এখন (বেলা ১২টা) পর্যন্ত মেসেজের উত্তর দেননি।’
অভিযুক্তদের ভাষ্য
অভিযুক্ত শিক্ষার্থী সিফাত উল্লাহ ঘটনার বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘কাল (রোববার) সারা রাত আমি আমার রুমে ঘুমিয়েছিলাম। যাদের কথা বলছেন, তাদের আমি ভালোভাবে চিনিও না। তাদেরকে মারধর করার প্রশ্নই আসে না।
‘আমি ছাত্রলীগের রাজনীতি করি। আমার রাজনীতি নষ্ট করার জন্য হয়তো তারা এসব বলছে।’
অভিযুক্ত অন্য শিক্ষার্থী মাহমুদ অর্পণকে একাধিকবার ফোন করা হলেও সেগুলো রিসিভ হয়নি। মোবাইলে খুদেবার্তা পাঠালেও তার উত্তর আসেনি।
এ বিষয়ে হল ছাত্রলীগের উপ দপ্তর সম্পাদক ইমরান সাগর বলেন, ‘এটি তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত বিষয়। এটির সাথে ছাত্রলীগ বা আমার গ্রুপের কোনো সংযুক্তি নেই।’
মারধরের আগে আরিফুলের ফোনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো সিনিয়র যদি জুনিয়রকে ডাকে তখন আমি তো নিষেধ করতে পারি না। তাই তাদেরকে অর্পণ এবং সিফাতের রুমে যেতে বলেছি।
‘তবে মারধরের বিষয়টি যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে হল কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেবে, সেখানে আমাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা থাকবে।’
ফোনে পাওয়া যায়নি প্রাধ্যক্ষকে
ঘটনার বিষয়ে হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক মকবুল হোসেন ভূঁইয়াকে একাধিকবার কল করলেও সেগুলো রিসিভ হয়নি। মোবাইলে খুদেবার্তা পাঠালেও তার উত্তর আসেনি।
মকবুল হোসেনের বিরুদ্ধে ফোন না ধরার অভিযোগ নতুন নয়। অভিযোগ আছে, তিনি শিক্ষার্থীদের ফোনও রিসিভ করেন না।