দেশের অন্যান্য স্থানের মতো নওগাঁতেও জানান দিচ্ছে শীতের বার্তা। দিনে ঠান্ডা তেমন অনুভব না হলেও গভীর রাত ও সকালে সূর্য ওঠার আগ পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে শীতের আমেজ।
আর শীতকাল মানেই অনেকটা পিঠাপুলির উৎসব। বাংলার ঘরে ঘরে এই সময় তৈরি হয় নানা রকম পিঠা। সেই পিঠার অন্যতম উপাদান খেজুর রসের লালি (হালকা জ্বালানো রস) ও গুড়।
এ ছাড়া খেজুর গুড়ের তৈরি রসগোল্লা, পায়েস, মোয়া ও সন্দেশ খাদ্যপ্রেমীদের যেন অন্য রকম তৃপ্তি।
খেজুরের রস সংগ্রহে গাছ তৈরিতে তাই শীতের শুরুতে দম ফেলার সময় থাকে না গাছিদের। নওগাঁ জেলার বিভিন্ন স্থানেই তাই এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন গাছিরা। চলছে গাছ তৈরি ও নলি বসানোর কাজ।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জেলায় ১৭৫ হেক্টর জমিতে খেজুরগাছ রয়েছে। চলতি বছর এসব গাছ থেকে গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৭৩ টন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জেলার বিভিন্ন স্থানে জমির আইল, রাস্তার পাশ এবং পুকুর পাড়ে সারি সারি খেজুরগাছের ডাল কেটে পরিষ্কার করতে ব্যস্ত গাছিরা। হাতে দা, কোমরে রশি বেঁধে নিপুণ হাতে গাছ তৈরি করছেন তারা। এরই মধ্যে অনেকে রস সংগ্রহের জন্য গাছে নলি গাঁথা শুরু করেছেন।
আর ১০-১৫ দিন পরই রস পাওয়া শুরু হবে বলে জানান জেলার একাধিক গাছি। তারা জানান, খেজুরগাছ থেকে রস পাওয়ার জন্য তৈরি করাকে তারা আঞ্চলিকভাবে ‘গাছ তোলা’ বলেন। প্রথমবার গাছ তোলার সাত দিন পরই হালকা কেটে নলি লাগানো হয়। পরে সেখান থেকে রস সংগ্রহ করে থাকেন তারা।
নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার নওদুলি গ্রামের গাছি সন্তোষ কুমার বলেন, ‘হামি এবার ২০টা গাছোত থ্যাকা রস সংগ্রহ করমু। এর মধ্যে আমার লিজের পাঁচটা গাছ আর এক গেরস্তের ১০টা গাছ। যার কাছে থ্যাকা গাছগুলা লিসি তাক ১০ কেজি লালি আর ৫ কেজি গুড় দেয়া লাগবে।
‘সে হিসাবেই গাছগুলা হামাক দিছে শীতের মৌসুমোত এইবার। আর প্রস্তুতি হামার প্রায় শেষ। ১০-১২ দিন পর থ্যাকা রস সংগ্রহ করবার পারমু। খুব একটা লাভ যে হয় তা কিন্তু লয়, যেহেতু এডা সিজিনারি একটা আয়ের পথ, তাই করি। অন্য সময় জমিত কৃষি কাম করি।’
আত্রাই উপজেলার নওদুলি গ্রামের গাছি ছাবের দেওয়ান খেজুরগাছ তৈরি ও রস সংগ্রহের বিষয়ে জানান, প্রথমে খেজুরগাছের মাথার অংশকে ভালো করে কেটে পরিষ্কার করা হয়। এরপর পরিষ্কার সাদা অংশ কেটে রস সংগ্রহ করা হয়।
অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে তারা কোমরে রশি বেঁধে গাছে ঝুলে রস সংগ্রহ করেন। এবার তিনি নিজের ১৭টি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করবেন।
তবে আগের মতো তাদের এলাকায় খেজুরগাছ পাওয়া যায় না জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক মালিক গাছ কেটে ফেলেছেন। তবে সেই পরিমাণ নতুন করে গাছ লাগানো হয়নি। শীতের সময় রস পাওয়া ছাড়া গাছগুলো থেকে তেমন কিছু হয় না। এ কারণে অনেকে খেজুরগাছ রাখেন না। আবার অনেকে গাছ কেটে বাড়ি নির্মাণে ব্যবহার করেন।
নওগাঁ সদর উপজেলার বক্তারপুর গ্রামের গাছি আলেফ উদ্দিন জানান, তিনি ২০টি খেজুরগাছ প্রস্তুত করেছেন রস সংগ্রহের জন্য। একটি গাছ থেকে সপ্তাহে পাঁচ দিন রস সংগ্রহ করা যায়। বাকি দুই দিন গাছ শুকানো হয়। এরপর রস সংগ্রহের স্থানের ওপরের বাকল তুলে হাঁড়ি বসানো হয়।
তিনি আরও জানান, একটি খেজুরগাছ থেকে প্রতিদিন চার কেজির মতো রস পাওয়া যায়। আর ছয় কেজি রস থেকে ১ কেজি গুড় পাওয়া যায়। লালির ক্ষেত্রে ৩ কেজি রসে মেলে ১ কেজি।
একই উপজেলার চক বালুভরা গ্রামের গাছি সাইফুল ইসলাম জানান, তিনি এ বছর ৪৫টি গাছ একজন মালিকের কাছ থেকে নিয়েছেন। মালিককে এক সিজনের জন্য দিতে হবে ১৫-২০ হাজার টাকা।
গুড় ও লালি তৈরিতে তার সঙ্গে কাজ করেন দুজন সহকারী। জ্বালানিসহ তার প্রতিদিন খরচ হবে প্রায় ৩০০ টাকার মতো।
তিনি বলেন, ‘গত বছর গুড় বিক্রি করেছিলাম ৮০ টাকা কেজিতে। আর লালি ৭০-৭৫ টাকা কেজি দরে। এবার যদি সেই রকম দাম থাকে তবে প্রতিদিন ৬০০-৮০০ টাকার মতো করে লাভ করতে পারব।’
সরকার শীত মৌসুমের আগেই অল্প সুদে ঋণ বা সহায়তা দিলে তাদের জন্য ভালো হতো জানিয়ে তিনি বলেন, তাহলে আরও বেশি পরিমাণ গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা যেত। কারণ আনুষঙ্গিক অনেক খরচ থাকে। যার কারণে ধার-দেনা করে কাজ চালাতে হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ি নওগাঁর উপপরিচালক কৃষিবিদ শামসুল ওয়াদুদ বলেন, ‘শীত এলেই গাছিরা প্রস্তুতি নেন। গাছের উপরিভাগের নরম অংশে চাঁছ দিয়ে রস নামানো হয়। একবার গাছে চাঁছ দিলে ২-৩ দিন রস পাওয়া যায়।
‘সাধারণত খেজুরগাছ পূর্ব ও পশ্চিম দিকে কাটা হয়, যাতে সূর্যের আলো সরাসরি ওই কাটা অংশে পড়তে পারে।’
তিনি জানান, জেলায় ১৭৫ হেক্টর জমিতে খেজুরগাছ রয়েছে। সেই হিসাবে গাছের সংখ্যা প্রায় ৮ হাজারের মতো। চলতি বছর ৮৭৩ টন গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
তবে গত বছরের চেয়ে এবার গাছের সংখ্যা কমেছে। কৃষি অফিস থেকে গাছিদের মাঠপর্যায়ে খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ ও ভালোমানের লালি বা গুড় উৎপাদনের বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
ঋণ বা কোনো ধরনের সহায়তার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘গাছিদের আলাদা করে কোনো ধরনের ঋণ সহায়তা দেয়া হয় না। কেউ যদি কৃষি ঋণের জন্য ব্যাংক থেকে লোন নিতে চায়, তবে পরামর্শ ও সহায়তা করা হবে।’