তেলের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ানোর কারণে বাস ভাড়া ২৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর ঘোষণা দেয়ার পর সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বললেন, ভাড়া আরও বেশি বাড়ানোর যুক্তি ছিল।
ডিজেলের দাম এক লাফে ১৫ টাকা বাড়ানোর পর বৃহস্পতিবার যখন প্রথমে ট্রাকমালিকরা ও পরে বাসমালিকরা ধর্মঘটের ডাক দেন, তখন তিন দিন সময় নিয়ে ভাড়া পুনর্নির্ধারণ কমিটির বৈঠক ডাকা নিয়েও ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান। তার দাবি, সবাইকে একসঙ্গে করতেই এই সময়টুকু দরকার।
রোববার বেলা ১১টার এই বৈঠকের দিকে তাকিয়ে ছিল সারা দেশের মানুষই। এর কারণ, তিন দিন ধরে বাসের চাকা না ঘোরায় মানুষের ভোগান্তি ছিল চরমে। পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকায় এমনিতেই বেড়ে যাওয়া কাঁচাবাজারের উত্তাপ আরও বেড়েছে।
তবে নির্ধারিত সময়ে বৈঠক শুরু হয়নি। পৌনে এক ঘণ্টা পর টেবিলে বসে দুই পক্ষ। আলোচনা চলে প্রায় সাত ঘণ্টা।
বিকেল পাঁচটার পর সাংবাদিকদের সামনে আসে দুই পক্ষ। ভাড়া বাড়ানোর পক্ষে বাসমালিকদের পাশাপাশি যুক্তি দেন বিআরটিএর চেয়ারম্যান নিজেই।
বৈঠকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ছাড়াও অন্য নেতারা ও ভোক্তাদের পক্ষে ছিলেন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রতিনিধিরা।
বৈঠকের শুরুতে দূরপাল্লার বাস ভাড়া ৪১ শতাংশ আর মহানগরে ৫০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দেন পরিবহনমালিকরা।
সবশেষ ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০১৩ সালে। তবে নগর পরিবহনের পাশাপাশি আন্তজেলার বহু রুটে এর চেয়ে অনেক বেশি হারে ভাড়া আদায় করা হয়। নতুন যে ভাড়ার হার নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি কঠোরভাবে কার্যকর করলে অনেক রুটে ভাড়া কমে যাবে।
নির্ধারিত হারে ভাড়া কখনও কার্যকর করতে না পারা বিআরটিএর চেয়ারম্যান কথা বললেন অনেকটা মালিকদের সুরে।
তিনি বলেন, ‘আট বছর ধরে বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়নি। আমরা আজকে ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটির মাধ্যমে হিসাব করে দেখেছি, গত আট বছরের ভাড়া ও এখনকার তেলের দাম সমন্বয় করতে গেলে দূরপাল্লার বাসে ৪৭ শতাংশ ও মহানগরীতে ৪৬ শতাংশ ভাড়া বাড়ানো দরকার।’
যদি এই হারে ভাড়া বাড়ানোই যুক্তিযুক্ত ছিল, তাহলে কেন কম নির্ধারণ করা হলো, তার কথাও বলেন বিআরটিএর প্রধান।
তিনি বলেন, ‘যেটা আবার সাধারণদের ওপর চাপ পড়ে। তাই ভাড়া সহনীয় পর্যায়ে রাখতে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তেলের হিসাবের সঙ্গে এই ভাড়া মেলালে চলবে না।’
বৈঠক শেষে জানানো হয়, ২০১৩ সালে নির্ধারিত দূরপাল্লার বাস ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা ৪২ পয়সা থেকে ১ টাকা ৮০ পয়সা আর ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা ৭০ পয়সা থেকে করা হয়েছে ২ টাকা ১৫ পয়সা।
আর মহানগরীতে মিনিবাসে ১০ পয়সা কম অর্থাৎ ২ টাকা ৫ পয়সা করে ভাড়া নেয়া হবে। তবে সিএনজিচালিত বাসের ভাড়া বাড়বে না।
অর্থাৎ দূরপাল্লার ভাড়া বেড়েছে ২৭ শতাংশ আর মহানগরে ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ।
সেই সঙ্গে জানানো হয়, মহানগরে মিনিবাসের সর্বনিম্ন ভাড়া হবে ৮ টাকা আর বড় বাসের ১০ টাকা।
বৈঠক শেষে বিআরটিএর চেয়ারম্যান যা বলেছেন, তার পাশে বসা বাসমালিকদের নেতা খন্দকার এনায়েত উল্লাহর বক্তব্যে পার্থক্য কমই
বিআরটিএর চেয়ারম্যান ও বাসমালিকদের সংগঠনের বক্তব্যে তেমন কোনো ফারাক নেই।
খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘২০১৩ সালের পর এখন পর্যন্ত বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়নি। গত আট বছরে বাসের প্রতিটি যন্ত্রাংশের দাম যে হারে বেড়েছে, চালক-কর্মচারীদের বেতন বেড়েছে, সেই হিসাব করলেও আজকের নতুন ভাড়া সমন্বয়টা হয় না।
‘তেলের বাড়তি দাম যদি আমরা ধরি, সে ক্ষেত্রে ভাড়া আরও অনেক বেশি বাড়ানো লাগে। আমরা আজকে তেলের হিসাব না ধরেই ভাড়া সমন্বয় করেছি। আমরা জনগণের কথা বিবেচনা করে সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে এই ভাড়া মেনে নিয়েছি।’
‘এই নতুন ভাড়ায় আমাদের খুব একটা লাভ থাকবে না। এই ভাড়ায় আমরা ব্রেক ইভেন পয়েন্টে থাকব’- এমনও বলেন খন্দকার এনায়েত।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা যাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। এক রকম জুলুম বলতে পারেন। আমরা এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করছি। সেই সঙ্গে সরকারকে আহ্বান করছি, সঠিক ভাড়া নির্ধারণ করে সাধারণ মানুষকে এই জুলুমের হাত থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হোক।’
এই বৈঠক তিন দিন পরে কেন?
বৃহস্পতিবার যখন জেলায় জেলায় ধর্মঘটের ডাক আসে, সেদিন বিআরটিএ শুক্র ও শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটি শেষে রোববার বৈঠক ডাকে। জরুরি পরিস্থিতিতেও তাদের সাপ্তাহিক ছুটি কাটানোর কারণে তিন দিনের দুঃসহ পরিস্থিতিতে যাত্রীরা গন্তব্যে যেতে অনেক বেশি টাকা খরচ করতে বাধ্য হন।
এমন পরিস্থিতিতেও বৈঠক কেন আগে করা হলো না- এমন প্রশ্নে বিআরটিএর চেয়ারম্যান বলেন, ‘পরিবহন মালিকপক্ষের সবাইকে একসঙ্গে পাওয়ার জন্য ও তাদের প্রস্তাব তৈরির জন্য একটু সময় দেয়া দরকার ছিল। সব মিলিয়ে আমাদের একটু প্রস্তুতির দরকার ছিল।’
সিএনজিচালিত বাসের ভাড়া বাড়বে না, কিন্তু কথা ঠিক থাকবে তো?
বৈঠক শেষে নতুন ভাড়া কেবল ডিজেলচালিত বাসের জন্য কার্যকর জানানো হলেও সিএনজিচালিত বাস আগের হারে ভাড়া নেবে কি না, সে সংশয় উঠেছে খন্দকার এনায়েত উল্লাহর বক্তব্যে।
নগর পরিবহনে যেসব বাস চলে তার মধ্যে সিএনজিতে চলে সিংহভাগ। অল্প কিছু বাস কেবল ডিজেলে চলে।
তবে খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘সিএনজিচালিত বাসেরও মেইনটেন্যান্স খরচ বেড়েছে। তাদের নতুন ভাড়ার আওতায় আনা না হলে তারাও বঞ্চিত থেকে যাবে।’
বাস মালিক সমিতির এই নেতার দাবি, সিএনজিচালিত বাসের সংখ্যা ২ থেকে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ। এই বাসগুলো শুধু মহানগরীতেই চলাচল করে। এই অল্পসংখ্যক বাসকে আলাদা করা উচিত হবে না।
তবে বিআরটিএর চেয়ারম্যান বলেন, ‘সিএনজিচালিত বাসের ভাড়া বাড়বে না, তাদের আগের ভাড়াই নিতে হবে। ধর্মঘটের সময় যেসব সিএনজিচালিত বাস তাদের সেবা বন্ধ রেখেছিল, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
সমিতির সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই ধর্মঘট!
এবার বাস ধর্মঘট কে ডেকেছে, সেই বিষয়টিই জানা গেল না এখনও।
ভাড়া পুনর্নির্ধারণ কমিটির বৈঠকে খন্দকার এনায়েতের কাছেই এই প্রশ্ন রাখেন গণমাধ্যমকর্মীরা। তার দাবি, তিনি নিজেই জানেন না।
বাস মালিক সমিতির এই নেতা বলেন, ‘গত ৩ নভেম্বর ডিজেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশের পরিবহনমালিকরা আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই ধর্মঘট পালন করা শুরু করেন।
‘তারা আলাদাভাবে বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে সংবাদ সম্মেলন করে তাদের দাবি ও সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন। পরে মালিকদের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমরাও একত্মতা প্রকাশ করি।
‘পাশাপাশি সাধারণদের দুর্ভোগের কথা মাথায় রেখে আমরা সরকারের বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু করি। যার ফলে আজকে এই সিদ্ধান্ত পাওয়া গেল।’