নরসিংদীর চরাঞ্চলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ নতুন কিছু নয়। আর আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন যেন হামলা, সংঘর্ষ, রক্তপাতের বিভীষিকায় নতুন মাত্রা যোগ করতে চলেছে। শঙ্কা দেখা দিয়েছে লাশের মিছিল আরো দীর্ঘ হওয়ার।
জেলার আলোকবালী ও রায়পুরার পর দুর্গম চরাঞ্চল চরদিঘলদীতে ইউপি নির্বাচন ঘিরে পুনরায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রতিপক্ষের হামলার শঙ্কায় গ্রামছাড়া হয়ে আছে ১ হাজার ২০০ পরিবার। তাতে করে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ছয় হাজার ভোটারের ভোটদানের সুযোগ।
এই জনপদে ইউপি নির্বাচনের সহিসংতায় দীর্ঘ হতে পারে লাশের মিছিল। ইতোমধ্যে পৃথক কয়েকটি সংঘর্ষে আটজন নিহত ও দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। তারপরও থেমে নেই নৈরাজ্য। আধিপত্য টিকিয়ে রাখাসহ নির্বাচনি বৈতরণি পার হতে রক্তপাতের নেশায় মেতে উঠেছে গ্রাম্যপতিরা (মাতব্বর)।
চরদিঘলদী ইউপিতে আগামী ১১ নভেম্বর ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনে ভোটবঞ্চিত করতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ দলটির অনুসারী প্রায় ১ হাজার ২০০ পরিবারকে গ্রামছাড়া করার অভিযোগ উঠেছে। এর প্রতিবাদে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছেন এলাকাবাসী।
অভিযোগ উঠেছে, এই ইউপিতে নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী দেলোয়ার হোসেন শাহীনের সমর্থকরা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুর চালান। পরে বর্তমান চেয়ারম্যানসহ প্রতিদ্বন্দ্বী তিনজন চেয়ারম্যান প্রার্থী, ১৫ জন মেম্বার প্রার্থী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের ১ হাজার ২০০ পরিবারের প্রায় ছয় হাজার ভোটারকে এলাকাছাড়া করা হয়।
অবশ্য নৌকা প্রতীকের প্রার্থী তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।
রোববার বেলা ১১টায় মানববন্ধন শেষে এলাকাবাসী সুষ্ঠু ভোটের দাবিতে সদর আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বীর প্রতীক, নরসিংদীর জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও র্যাব-১১ দপ্তরে অভিযোগ দাখিল করেন।
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, চরদিঘলদী ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন তিনজন। শেষ পর্যন্ত দেলোয়ার হোসেন শাহীন দলীয় মনোনয়ন পান। তাতে নাখোশ হন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী হন তিনজন। এ অবস্থায় নিজের শক্তি বাড়াতে নৌকার প্রার্থী হাত মেলান চরদিঘলদী ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি ও বিগত নির্বাচনে ধানের শীষের চেয়ারম্যান প্রার্থী ইউনুস এবং তার সন্ত্রাসী বাহিনীর সঙ্গে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৮ অক্টোবর আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সন্ত্রাসীরা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের বাড়িতে হামলা চালায়। তারা বেশ কয়েকটি বাড়িঘর ভাঙচুর ও প্রায় এক শ গরু লুট করে। পরে নৌকার প্রার্থী দেলোয়ার হোসেন শাহীন বর্তমান চেয়ারম্যান মনসুর ও স্বতন্ত্র তিন চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ ছয়টি ওয়ার্ডের নির্বাচিত মেম্বার ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ প্রায় ১ হাজার ২০০ আওয়ামী পরিবারকে এলাকাছাড়া করে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন।
সুষ্ঠু ভোট আয়োজনে ইসি কবিতা খানমের নির্দেশ
রোববার নরসিংদীর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে নরসিংদী সদর ও রায়পুরা উপজেলার মোট ১২টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন উপলক্ষে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা উপস্থিত থেকে তাদের অভিযোগ তুলে ধরেন।
স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী আব্দুল জলিল মিয়া অভিযোগ করে বলেন, ‘নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী আমাদের প্রচারে বাধা দিচ্ছেন। প্রতিবাদ করলেই আমাদের বাড়িঘরে হামলা ও কর্মী-সমর্থকদের মারধর করছেন। এমনকি আমাদের গ্রামের প্রায় ১ হাজার ২০০ পরিবারকে গ্রামছাড়া করা হয়েছে। আমরা গ্রামে ফিরে নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চাই।’
আরেক প্রার্থী সাইদ মিয়া বলেন, ‘আমি ভোটের প্রচার চালানোর সময় নৌকার চেয়ারম্যান প্রার্থী শাহীনের লোকজন হামলা চালান। ওই সময় তারা আমার চাচাতো ভাইয়ের ওপর হামলা চালিয়ে তার চোখে উপড়ে ফেলেন। শরীরের কয়েক জায়গায় টেঁটাবিদ্ধ করেন। তিনি এখন মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আমি এর বিচার চাই।’
অপর স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী আমির হোসেন বলেন, ‘নৌকার প্রার্থী দোলোয়ার হোসেন শাহীন আমাদের গ্রামে ঢুকতে দিচ্ছেন না। তারা চরদিঘলদীর তিন স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী ও ১০ মেম্বার প্রার্থীসহ সবাইকে গ্রাম থেকে বের করে দিয়েছেন। গ্রামে গেলেই আমাদের ওপর হামলা করছেন।’
মতিবিনিময় সভায় নৌকার প্রার্থী দেলোয়ার হোসেন শাহীন উপস্থিত ছিলেন না। সভা শেষে নিউজবাংলার পক্ষ থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে এসব ষড়যন্ত্র। বিরোধী পক্ষ একজোট হয়ে ভোটে আমাকে হারানোর জন্য নানামুখী পাঁয়তারা করছে।’
পরে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আবারো তার সঙ্গে কথা বলার জন্য মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
মতবিনিময় সভায় ইসি কবিতা খানম বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কমিশনের নির্দেশনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। কেউ যেন নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ইতোপূর্বে যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর যেন পুনরাবৃত্তি না হয়।’
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) শাহেদ আহমেদ বলেন, ‘ইতোপূর্বে অভিযান চালিয়ে চরদিঘলদী থেকে তিনটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। অস্ত্র উদ্ধারে প্রতিদিন পুলিশের অভিযান চলছে।’ তিনি আরো বলেন, চরাঞ্চলের মানুষের মানসিকতার বিকাশ ঘটাতে হবে। আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তবেই টেঁটাযুদ্ধ বন্ধ হবে।’
জেলা প্রশাসক আবু নাঈম মো. মারুফ খানের সভাপতিত্বে সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজিম ও ঢাকা অঞ্চলের নির্বাচন কর্মকর্তা মাহফুজা খানম।