কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে চলনবিলের নির্দিষ্ট গন্তব্যে রওনা দেন সবাই। কাদাপানি মাড়িয়ে দুর্গম বিল পেরিয়ে পাখি শিকারিদের ধরতে যান তারা। খেজুরপাতা, কলাপাতা, বাঁশ ও পাটকাঠি দিয়ে তৈরি ফাঁদ ধ্বংস করে পাখি উদ্ধার করেন। পরে সুবিধাজনক জায়গায় অবমুক্ত করা হয় উদ্ধার করা পাখি।
সাড়ে সাত বছরে চলনবিলের নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনার সীমানা থেকে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় প্রায় ৩০০ অভিযান পরিচালনা করেছেন ‘চলনবিল জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটি’ নামের এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা। উদ্ধারের পর অবমুক্ত করেছেন সাদা বক, বালিহাঁস, শালিক, চাকলা, ঘুঘু, তিতির, শামুককল, হটটিটিসহ কয়েক হাজার অতিথি পাখি।
২০১২ সালের মার্চে চলনবিল অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য, বন্য প্রাণী ও পাখি রক্ষায় ১১ জন তরুণকে নিয়ে সংগঠনটি গড়ে তোলেন সাইফুল ইসলাম। পরে ২০১৪ সালের জুনে শিক্ষক, সমাজসেবক, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী ও তরুণদের নিয়ে গঠন করা হয় ‘চলনবিল জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটি’র ১০১ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি।
‘চলনবিলের ঐতিহ্য ধরে রাখব, সবাই মিলে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করব’ এই স্লোগান সামনে নিয়ে জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও পরিবেশ সচেতনতার আন্দোলনে কাজ করছেন তারা। নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জের নয়টি উপজেলায় সক্রিয় রয়েছে এই কমিটি।
শিকারিদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া ফাঁদ। ছবি: নিউজবাংলাসংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম জানান, ফাঁদসহ শিকারিদের ধরার পর আর কখনও পাখি শিকার করবে না এমন মর্মে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। কোনো কোনো সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে হাজির করা হয় তাদের। অপরাধ অনুযায়ী ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা হয় তাদের।
তিনি জানান, সংগঠনের সদস্যদের অভিযানে প্রশাসনের সহযোগিতায় ১১ জন পেশাদার পাখি শিকারিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড এবং ২৯ জন শিকারিকে অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। গহিন বিলে পাখি শিকারের জন্য খেজুরপাতা, কলাপাতা, বাঁশ, পাটকাঠি দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি প্রায় ৫০০ ফাঁদঘর ধ্বংস করা হয়েছে। এ ছাড়া উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় ৩০০ কারেন্ট জাল ও ফাঁদ। জব্দ করা হয়েছে চারটি ইয়ারগান।
চলনবিল থেকে হিমালয়ী গৃধিনী নামে বিপন্ন প্রজাতির একটি শকুন, বাঘডাশা, মেছো বাঘের ছানা, গন্ধগোকুল উদ্ধার করেও অবমুক্ত করা হয়েছে বলে জানান সাইফুল ইসলাম।
চলনবিল জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ আকতারুজ্জামান বলেন, ‘জীববৈচিত্র্য রক্ষায় চলনবিলের বড় অংশজুড়ে স্বেচ্ছাশ্রমে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিন পরিবেশকর্মীরা চলনবিলের বিভিন্ন দুর্গম স্থানে অভিযান চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে শিকারিদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া বকপাখিসহ পরিযায়ী অনেক পাখি মুক্ত আকাশে ছাড়া হয়েছে।’
চলনবিলের গহিন থেকে শিকারিদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া পাখি। ছবি: নিউজবাংলাতিনি বলেন, ‘এ ছাড়া প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকার সাধারণ মানুষকে পাখি শিকার বন্ধে সচেতন করা হচ্ছে। সংগঠনের সদস্যরা নিয়মিত বিভিন্ন এলাকায় পথসভা, সেমিনার ও সচেতনতামূলক লিফলেটসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন।’
সিংড়া উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) রকিবুল হাসান বলেন, ‘চলনবিলের জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সদস্যরা প্রতিদিন স্বেচ্ছাশ্রমে পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখতে অভিযান চালু রেখেছে। এ পর্যন্ত তারা অতিথি পাখিসহ কয়েক হাজার পাখি উদ্ধার করে অবমুক্ত করেছে। এই সংগঠনের সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুর্গম চলনবিলে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করছেন।’
তিনি বলেন, ‘তাদের তৎপরতায় এখন এই অঞ্চলে প্রকাশ্যে পাখি কেনাবেচা বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষ যখন পাখি শিকারে ব্যস্ত, তখন এই তরুণদের প্রতিদিনের কর্মকাণ্ড খুবই মহৎ একটি কাজ। আগামী প্রজন্মকে ভালো একটি পরিবেশ দিতে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাদের এই উদ্যোগ সত্যিই অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।’