বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ভালো কাজের বিনিময়ে ভরপেট খাওয়া

  •    
  • ৭ নভেম্বর, ২০২১ ১১:৩২

কেউ ট্রেন থেকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে নামতে সাহায্য করেছেন, কেউ কোনো শ্রমিককে একটা বস্তা মাথায় তুলে দিয়েছেন, রাস্তা থেকে ময়লা তুলে ডাস্টবিনে ফেলেছেন কেউ। সারা দিনে এ রকম ভালো কাজ করলেই জুটে যাবে একবেলার ভরপেট খাওয়া। কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক রাজধানীর তিনটি জায়গায় চালু করেছেন অসহায় মানুষকে খাওয়ানোর এই কর্মসূচি।

হোটেলের নাম ‘ভালো কাজের হোটেল’। বিনা পয়সায় খাওয়া যাবে। ভরপেট। তবে এক শর্তে, আপনাকে অন্তত একটা ভালো কাজ করতে হবে। আপনি বলবেন, অপরের উপকারে লাগে এমন কী কাজ করেছেন সারা দিনে। আপনাকে খেতে দেয়া হবে।

রাজধানীতে কমলাপুর স্টেশন এলাকায় এ রকম একটি অস্থায়ী হোটেল বসছে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর।

তবে ভালো কাজ না করে থাকলে কাউকে যে ফিরিয়ে দেয়া হয়, তা নয়। তখন শর্ত দেয়া হয়, পরের দিন দুটি ভালো কাজ করতে হবে।

এই হোটেলের শুরু ২০১৯ সালে। এটির পেছনে আছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ইয়ুথ ফর বাংলাদেশ’। এই সংগঠন যাত্রা শুরু করেছিল ২০০৯ সালে।

প্রথমে এটির কাজ ছিল বিভিন্নভাবে অসহায় দরিদ্র মানুষকে সহায়তা করা, এক থেকে ১১ বছরের শিশুদের হৃদরোগ ও ব্লাড ক্যানসারের চিকিৎসা দেয়া, বন্যার্তদের মাঝে সাহায্য দেয়া ও শীতবস্ত্র বিতরণ। এর পাশাপাশি বছরে তিন থেকে চারবার অসহায় মানুষকে খাওয়াতো সংগঠনটি।

গত রোববার সন্ধ্যা ৭টায় কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ছাড়িয়ে আরেকটু সামনে গিয়ে দেখা যায়, ফুটপাতে ৮০ জনের দীর্ঘ একটা লাইন। তাদের খেতে দেয়া হচ্ছে। এদের খাওয়া হয়ে গেলে আরেক সারি লোক বসবে। এভাবে চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত।

সবার হাতে একটা করে প্লেট। কিছুক্ষণের মধ্যে ‘ভালো কাজের হোটেল’ লেখা টি-শার্ট পরা কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক এসে লাইনে বসা মানুষকে খিচুড়ি ও ডিম দিলেন। সবাই খাওয়া শুরু করেছেন।

এর মধ্যে একজন একটি ভালো কাজের বিবরণ নিতে একটি খাতা ও কলম নিয়ে এসেছেন। কে কী ভালো কাজ করেছেন, সেটা খাতায় লিখে নিচ্ছেন তিনি।

খাতায় দেখা যায়, কেউ ট্রেন থেকে প্রতিবন্ধী কোনো ব্যক্তিকে নামতে সাহায্য করেছেন, কেউ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে রাস্তা পার করে দিয়েছেন, কেউ কোনো শ্রমিককে একটা বস্তা মাথায় তুলে দিয়েছেন, রাস্তা থেকে ময়লা তুলে ডাস্টবিনে ফেলেছেন, বাইক থেকে পড়ে যাওয়া ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছেন, একজনকে পানি এনে দিয়েছেন ইত্যাদি।

খেতে আসা কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। এদের বেশির ভাগই কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের আশপাশে থাকেন। এরা প্রতিদিনই এখানে খাওয়া-দাওয়া করেন। কিছু মানুষ দল বেঁধে আসেন গুলিস্তান থেকে। এই রাস্তা দিয়ে অনেক হেঁটে যাওয়া মানুষ এবং রিকশাওয়ালাও এখানে এসে খান।

এদের একজন হাওয়া বিবি নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘কেউ নাই আমার। স্টেশনের সামনেই রাস্তায় থাহি। তাই প্রত্যেক দিন এইহানে খাই। হ্যারা আছে বইলাই রাইতের খাওন নিয়ে চিন্তা করোন লাগে না। আমার মতো অনেকেই আহে এইহানে খাইতে।’

সুজন মিয়ার বাড়ি মাগুরা। ঢাকায় এসেছেন কাজের খোঁজে। থাকেন গুলিস্তান পাতাল মার্কেট এলাকায়। তিনিও এসেছেন এখানে খেতে।

তিনি বলেন, ‘আগেও একদিন আসছিলাম খাইতে, আজকেও আসছি। বাড়ি থেকে ঝামেলা করে ঢাকায় আসছি কাজ খুঁজতে। তবে কাজ পাচ্ছি না। গুলিস্তানে রাস্তার মানুষের সঙ্গে থাকি। টাকা-পয়সা নাই, তাই এখানে খেতে আসলাম।’

ঢাকায় প্রতিদিন ‘ভালো কাজের হোটেল’ বসে তিনটি জায়গায়– কমলাপুর, কাওরান বাজার ও বনানী ১১ নম্বর কড়াইল বস্তিতে। বনানীতে বসে সকাল সাড়ে ১১টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত, কাওরান বাজারে দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত আর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। তবে শুক্রবার বাদে। ওই দিন কোনো একটি মসজিদ বা মাদ্রাসায় খাওয়ানো হয়।

তিন হোটেলে প্রতিদিন সাত শ থেকে সাড়ে সাত শ অসহায় মানুষকে খাওয়ানো হয়।

স্বেচ্ছাসেবকদের খাবার দেয়ার দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন মনিরুজ্জামান মনির। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, “খাবার রান্না হয় বাসাবোতে একটি ভাড়া করা ছাপড়া বাসায়। সেখানে একজন বাবুর্চি আছেন, যার দুই নাতি এই সংগঠনের ‘ডেইলি টেন স্কুলে’ পড়ে। এ কারণে তিনি খুব অল্প বেতনে রান্না করে দেন। আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা বাবুর্চিকে রান্নায় সাহায্য করে।”

মনির আরও জানান, মাসে দুই মঙ্গলবার তারা বাজার করেন। তাই মাঝে মাঝে এই দুই মঙ্গলবার খাবার দেয়া বন্ধ থাকে। সপ্তাহের অন্য ছয় দিনের দুই দিন থাকে মুরগি অথবা খাসির তেহারি। দুই দিন থাকে সাদা ভাতের সঙ্গে সবজি অথবা মুরগির গিলা-কলিজার লটপটি। বাকি দুই দিন ডিম খিচুড়ি।

যেভাবে শুরু

ভালো কাজের হোটেলের ধারণাটি এসেছে লেখক হুমায়ূন আহমেদের লেখার সূত্র ধরে।

সংগঠনটির উদ্যোক্তা ও প্রধান আরিফুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, “যখন আমি সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি, তখন হুমায়ূন আহমেদের ‘সবুজ ছায়া’ নাটক দেখি। এই নাটকে জাহিদ হাসান অভিনয় করেছিলেন। সেখানে জাহিদ হাসান প্রত্যেক দিন একটা ভালো কাজ করতেন। সেটা ছোটবেলায় আমার হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিল। তখন থেকেই আমি চেষ্টা করতাম একটা-দুইটা ভালো কাজ করা যায় কি না।”

২০০৯ সালে চার-পাঁচজন বন্ধুর সঙ্গে আরিফুর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ইয়ুথ ফর বাংলাদেশ’। দ্রুতই সেটা ১১০ সদস্যে দাঁড়ায়। এখন ১ হাজার ২শর বেশি সদস্য এ সংগঠনের।

২০১০ সালে বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে এ সংগঠনের কার্যক্রম দেখানোর পর এটির সদস্যসংখ্যা দ্রুত বাড়ে।

ভালো কাজের বিনিময়ে খাওয়ানোর কর্মসূচি শুরুতে অনিয়মিত ছিল। ২০১৯ সালে ‘ভালো কাজের হোটেল’ নাম দিয়ে সেটি নিয়মিত কার্যক্রমে পরিণত হয়। করোনার কারণেই এটি নিয়মিত হয়ে ওঠে।

আরিফুর রহমান বলেন, ‘শুধু ভালো কাজ করেছে এ জন্য যে খাবার দিই, তা না। অনেকেই বলেন যে, মামা আজকে কোনো ভালো কাজ করি নাই। তিনি যে ভালো কাজ করেন নাই, এই সত্য কথা বলাটাও একটা ভালো কাজ। বেশির ভাগ সময় মানুষ অপরাধ করে পেটের ক্ষুধা থেকে। তাদের পেটের ক্ষুধা কমিয়ে ভালো কাজে ধাবিত করাই আমাদের উদ্দেশ্য।’

স্বেচ্ছাসেবকরা নিয়মিত চাঁদা দিয়ে সংগঠনের খরচ চালান। এর বাইরে কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী আছেন। অনেকে সংগঠনের সদস্য না হয়েও সাহায্য করেন। দেশের বাইরে থেকেও অনেকে সাহায্য করেন।

সংগঠনের অন্যান্য কাজ

ভালো কাজের হোটেল চালানো ছাড়াও আরও দুটি কাজ করে ‘ইয়ুথ ফর বাংলাদেশ’। একটি হলো ‘ডেইলি টেন স্কুল’ আরেকটি অসহায়দের চিকিৎসা সহায়তা।

‘ডেইলি টেন স্কুল’ নামে বাড্ডা, বাসাবো ও মাদারীপুরে আমাদের তিনটি স্কুল আছে, যেগুলায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৬০। জুনিয়র ওয়ান থেকে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ানো হয় এখানে। শিশুরা এখান থেকেই পিএসসি পরীক্ষা দিয়ে থাকে।

স্বেচ্ছাসেবকরা প্রতিদিন ১০ টাকা করে জমিয়ে মাসে ৩০০ টাকা এই সংগঠনে জমা দেন। সেই টাকায় স্কুল চলে বলেই স্কুলের নাম ‘ডেইলি টেন’।

স্বেচ্ছাসেবকদের প্রায় সবাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। কয়েকজন চাকরিজীবীও আছেন।

এ বিভাগের আরো খবর