বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

৭ নভেম্বর: মুক্তিযোদ্ধা অফিসার হত্যার শুরু যেভাবে

  •    
  • ৭ নভেম্বর, ২০২১ ১০:৪৮

৭ নভেম্বর প্রথম প্রকাশ্যে হত্যার শিকার হন ২ জন সেক্টর কমান্ডার ও ১ জন সাব সেক্টর কমান্ডার। আর এই ৭ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে ২১ জুলাই ১৯৭৬ সালে ফাঁসিতে মৃত্যুবরণ করেন আরেকজন সেক্টর কমান্ডার। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর ভেতরে ১৩ জন হত্যার শিকার হন। স্বাধীনতা যুদ্ধেও কোনো সেক্টর কমান্ডারকে প্রাণ হারাতে হয়নি।

স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের তিন বীর সেনানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল ৭ নভেম্বরের ঘটনাবহুল দিন। বিদ্রোহ ও অরাজকতার বলি হয়েছিলেন খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম, কে এন হুদা বীর উত্তম এবং এ টি এম হায়দার বীরবিক্রম। সে সময় সেনাবাহিনীর মধ্যে কোনো চেইন অফ কমান্ড ছিল না।

ইতিহাসবিদ, প্রতক্ষ্যদর্শী ও রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকারদের মতে, ৭ নভেম্বরের এই অভ্যুত্থান নাটকের বীজতলা তৈরি হয় চারদিন আগে ৩ নভেম্বরের এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে।

সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহ্যাস ‘বাংলাদেশ এ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ বইয়ে লিখেছেন, ‘এদিন উচ্ছৃঙ্খল জওয়ানরা একজন মহিলা ডাক্তারসহ ১৩ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এমনকি একজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রীকেও এ সময় হত্যা করা হয়। এ রকম জঘন্য ঘটনায় ভরপুর ছিল ১৯৭৫ এর ৭ নভেম্বরসহ পরবর্তী ঘটনাগুলো। আবার অনেক ঘটনা হয়তো রিপোর্টের নজর এড়িয়ে গেছে কিংবা সংরক্ষণে রাখা হয়নি।’

ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন তার বাংলাদেশ: রক্তাক্ত অধ্যায় (১৯৭৬-৮১) বইতে ৭ নভেম্বর নিয়ে লিখেছেন, ‘সেদিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমান্ড স্ট্রাকচার সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে এবং চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা ধারণ করে। এ রকম অস্থিতিশীল অবস্থা পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে ঘটেছে বলে মনে পড়ে না এবং কারো পক্ষে কিছু বলার বা করারও ছিল না। ৭ নভেম্বরের রেশ থেকে যায় দীর্ঘদিন এবং সেনাবাহিনীতে ক্যু স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়। ৭ নভেম্বরের পর থেকে জেনারেল জিয়া হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত সর্বমোট ২১টি ছোটবড় সশস্ত্র রক্তাক্ত অভ্যুত্থান হয় এবং ২১তম অভ্যুত্থানে নিহত হয় জিয়াউর রহমান।’

কর্নেল ফারুক ও রশিদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে ৭ নভেম্বরের পটভূমি সম্বন্ধে অনেক কথা জানা যায়। তারা উল্লেখ করেন: জিয়া তার নিজ বাসভবনেই ছিলেন এবং ব্যক্তিগত দেহরক্ষী এবং পদাতিক বাহিনীর কোম্পানির প্রহরাধীন ছিলেন, ছিল ব্যক্তিগত স্টাফরাও। সুতরাং তিনি বন্দি ছিলেন না এবং বিদ্রোহ দমনের জন্য কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টাও করেননি। জিয়ার স্ত্রী ফারুক এবং রশিদকে এই মর্মে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, তার স্বামী আটকাবস্থায় নেই এবং কতিপয় সামরিক অফিসারদের সঙ্গে মিটিং করছেন।

৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত কর্নেল শাফায়াত জামিল রচিত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর শীর্ষক বইতে লিখেছেন: ‘সিপাহী বিদ্রোহে অংশ নেয়া সিপাহীরা ছিল পাকিস্তান প্রত্যাগত এবং তারা কেউই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কোনো ব্যাটালিয়নে ছিল না। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যড়যন্ত্র এবং জঘন্য হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ার জন্যই বিশেষ মহল ৭ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। আর বিশেষ মহলের নেপথ্যে কারা ছিল তা জাতির নিকট অত্যন্ত স্পষ্ট।’

লেখক ও গবেষক আনোয়ার কবির বলেন, ‘৭ নভেম্বর প্রথম প্রকাশ্যে হত্যার শিকার হন ২ জন সেক্টর কমান্ডার ও ১ জন সাব সেক্টর কমান্ডার। আর এই ৭ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে ২১ জুলাই ১৯৭৬ সালে ফাঁসিতে মৃত্যুবরণ করেন আরেকজন সেক্টর কমান্ডার। এ ছাড়া, সেনাবাহিনীর ভেতরে ১৩ জন হত্যার শিকার হন। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধেও কোনো সেক্টর কমান্ডারকে হারাতে হয়নি। আর তাই হত্যার নৃশংস ভয়াবহতা ৭ নভেম্বরকে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ে পরিণত করেছে।’

যেভাবে হত্যা করা হয় তিন মুক্তিযোদ্ধাকে

৭ নভেম্বর সবচেয়ে বড় যে হত্যাকাণ্ডটি সংগঠিত হয় সেটি সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশারফ, এ টি এম হায়দার ও সাব সেক্টর কমান্ডার খন্দকার নাজমুল হুদার। শেরে বাংলা নগরে ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে সকালে এই হত্যাকাণ্ডটি সংগঠিত হয়। মূলত এই হত্যাকাণ্ড জিয়াউর রহমানকে এককভাবে সেনা নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা করে।

এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানা রকম মত ও বক্তব্য রয়েছে।

আনোয়ার কবির বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা হিসেবে জিয়াউর রহমান, কর্নেল তাহের, মীর শওকত আলী এবং হত্যাকারী হিসেবে মেজর আসাদ ও মেজর জলিল নামে দুই জন অফিসার, উত্তেজিত সিপাহীদের কথা বলা হয় এবং এ নিয়ে কিছু বিবরণও পাওয়া যায়। এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে সেনাবাহিনী থেকে আজ পর্যন্ত কোনো কোর্ট অব ইনকোয়ারি হয়নি। আমি আমার ব্যক্তিগত পর্যায়ে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সে সময়ে ১০ম বেঙ্গলে উপস্থিত থাকা কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে যেটি জানতে পেরেছি তাতে সে সময়ে ১০ম বেঙ্গলে নিহত ওই তিন জন ছাড়াও আরও নয় জন অফিসার উপস্থিত ছিলেন বলে মনে হয়েছে।

তারা হলেন: লে. কর্নেল নওয়াজেশ উদ্দীন (সিও ১০ম বেঙ্গল, পরবতীতে কর্নেল ও ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮১ সালে জিয়া হত্যাকাণ্ডের জন্য কোর্ট মার্শালে ফাঁসিতে মৃত্যুবরণ করেন), লে. মুজিবুর রহমান (বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম বিএমএ অফিসার, পরবর্তীতে মেজর, ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮১ সালে জিয়া হত্যাকাণ্ডের জন্য কোর্ট মার্শালে মৃত্যুবরণ করেন), মেজর কাইউম (বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ওয়ার কোর্সের অফিসার), কর্নেল সিরাজ, ক্যাপ্টেন মোক্তাদির (বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ওয়ার কোর্স বা সেকেন্ড এসএস-এর অফিসার, মেজর হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত), ক্যাপ্টেন আলম ফজলুর রহমান (বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ওয়ার কোর্স বা সেকেন্ড এসএস-এর অফিসার, পরবর্তীতে সেনাবাহিনীতে মেজর জেনারেল ও বিডিআর প্রধান হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত), মেজর নাসির, মেজর আসাদ (বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ওয়ার কোর্সের অফিসার) এবং মেজর জলিল (বাংলাদেশ সেনাহিনীর প্রথম ওয়ার কোর্সের অফিসার)।

এই অফিসারদের অধিকাংশ এখনও জীবিত। সুতরাং সরকার উদ্যোগ নিলে এ হত্যাকাণ্ডে রহস্য উন্মোচন এবং হত্যাকারীদের বিচার করা খুব বেশি কঠিন নয়।

তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা বইতে লে. কর্নেল (অব.) এম. এ. হামিদ, পিএসসি ৭ নভেম্বর দিন খালেদ মোশারফ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে লিখেছেন: ‘সকাল ৭ ঘটিকা। টু-ফিল্ড রেজিমেন্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সৈনিকদের ব্যস্ততা, দ্রুত আনাগোনা প্রত্যক্ষ করছিলাম। তারা হেলেদুলে ঘুরছে-ফিরছে আপন খেয়ালে। অন্য সময় হলে অফিসারদের পাশ দিয়ে যেতে তাদের স্মার্ট স্যালুট দিয়ে চলতে হতো। আজ এসবের বালাই নেই। আজ তাদের রাজ্যে তারাই রাজা।

‘এমন সময় সৈনিকদের ভিড় ঠেলে একটি আর্মি ট্রাক শোঁ শোঁ বেগে এগিয়ে এলো। ভেতর থেকে নেমে এলো একজন তরুণ লেফটেন্যান্ট। স্যালুট দিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, স্যার, জেনারেল জিয়া কোথায়? জরুরি ব্যাপার আছে। বললাম, কী ব্যাপার আমাকেই বলো।

‘সে বলল, স্যার, খুবই জরুরি, ওনাকেই বলতে হবে। আমাকে ওনার কাছে নিয়ে চলুন প্লিজ! ওই দিন প্রোটোকলের কোনো বালাই ছিল না। বললাম, আসো, আমার সাথে।’

এম. এ. হামিদ আরও লেখেন, “আমি তাকে নিয়ে জিয়ার কামরায় ঢুকলাম, তাকে বললাম, এই ছেলেটি তোমাকে কিছু বলতে চায়। লেফটেন্যান্ট তৎক্ষণাৎ জিয়াকে একটি স্মার্ট স্যালুট দিয়ে বলল, ‘স্যার, আই হ্যাভ কাম টু প্রেজেন্ট ইউ ডেড বডি অফ খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা অ্যান্ড হায়দার, স্যার’। জিয়া অবাক! ব্রিগেডিয়ার খালেদের ডেডবডি। আমার দিকে তাকিয়ে জিয়া বললেন, ‘দেখো তো হামিদ, কী ব্যাপার’। আমি অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে দাঁড়ানো খোলা ট্রাকের পেছনে গিয়ে উঠলাম। সেখানে দেখি ট্রাকের পাটাতনে খড় চাপা দিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে তিনটি মৃতদেহ। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা ও কর্নেল হায়দার। খালেদের পেটের ভুঁড়ি কিছুটা বেরিয়ে আসছিল। তাকে পেটের মধ্যে গুলি করা হয়েছিল, হয়তো বা বেয়নেট চার্জ করা হয়েছিল। কী করুণ মৃত্যু!

“আমি জিয়াকে কামরায় গিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, খালেদ, হুদা আর হায়দারের ডেডবডি’। সে জিজ্ঞাসা করল, এগুলো এখন কী করা যায়? আমি বললাম, ‘আপাতত এগুলো সিএমএইচ-এর মর্গে পাঠিয়ে দেই’। জিয়া বলল, ‘প্লিজ হামিদ, এক্ষুণি ব্যবস্থা করো’।”

এম. এ. হামিদ লিখেছেন, ‘হায় খালেদ মোশাররফ! তিনি ৭ নভেম্বর ক্যান্টনমেন্টে ফিরে এলেন বটে। তবে জীবিত নয়, ফিরে এলো তার প্রাণহীন দেহ। আমি লেফটেন্যান্টকে ডেডবডিগুলো সিএমএইচ-এ নিয়ে যেতে বললাম। আমার জিপ ছিল না। রাতে বিপ্লবীরা আমার জিপটি গ্যারেজ থেকে নিয়ে গেছে। তাকেই রেখে আসতে বললাম।’

১০ ম বেঙ্গলে কী ঘটেছিল

একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী ও গবেষকের বইপত্র থেকে ৭ নভেম্বর খালেদ মোশাররফসহ তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তার হত্যাকাণ্ডের মুহূর্তটির যে চিত্র পাওয়া যায়, তা এরকম:

রাত ১২টায় সেপাই বিপ্লবের খবর পেয়ে জেনারেল খালেদ মোশাররফ দ্রুত তার প্রাইভেট কার নিয়ে বঙ্গভবন থেকে দ্রুত বেরিয়ে যান। তিনি নিজেই ড্রাইভ করছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন কে এন হুদা ও এ টি এম হায়দার। দুজন ওইদিনই ঢাকার বাইরে থেকে এসে খালেদের সাথে যোগ দেন।

খালেদ মোশাররফ প্রথমে ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের বাসায় যান। সেখানে তার সঙ্গে পরামর্শ করেন। নুরুজ্জামান তাকে ড্রেস পাল্টে নিতে অনুরোধ করে। তিনি তার নিজের একটি প্যান্ট ও বুশ শার্ট খালেদকে পরতে দেন। মৃত্যুর সময় ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের দেয়া এই ছোট সাইজের সার্ট-প্যান্টই পরে ছিলেন খালেদ মোশাররফ।

সেখান থেকে খালেদ মোশাররফ কলাবাগানে তার এক আত্মীয়ের বাসায় যান। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করেন এবং কয়েক জায়গায় ফোন করেন। ৪র্থ বেঙ্গলে সর্বশেষ ফোন করলে ডিউটি অফিসার লে. কামরুল ফোন ধরেন। লে. কামরুল তাকে প্রকৃত অবস্থা অবহিত করেন। খালেদ মোশাররফ বুঝতে পারেন অবস্থা খুবই নাজুক। তিনি অবস্থান পরিবর্তন করে শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাম্পে আশ্রয় গ্রহণ করতে যান। ১০ম বেঙ্গলকে বগুড়া থেকে তিনিই আনিয়েছিলেন তার নিরাপত্তার জন্য। পথে ফাতেমা নার্সিং হোমের কাছে তার গাড়ি খারাপ হয়ে গেলে তিনি কর্নেল হুদা ও হায়দারসহ পায়ে হেঁটেই ১০ম বেঙ্গলে গিয়ে পৌঁছেন।

প্রথমে নিরাপদেই তারা বিশ্বস্ত ইউনিটে আশ্রয় নেন। তখনও সেখানে সিপাহিদের বিদ্রোহের ঢেউ এসে লাগেনি। কমান্ডিং অফিসার ছিলেন কর্নেল নওয়াজিশ। তাকে দেওয়া হয় খালেদ মোশাররফের আগমনের খবর। তিনি তৎক্ষণাৎ টেলিফোনে টু-ফিল্ডে সদ্যমুক্ত জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তার ইউনিটে খালেদ মোশাররফের উপস্থিতির কথা জানিয়ে দেন। তখন ভোর প্রায় চারটা। জিয়ার সঙ্গে ফোনে কর্নেল নওয়াজিশের কিছু কথা হয়। এরপর তিনি (মেজর জিয়া) মেজর জলিলকে ফোন দিতে বলেন। জিয়ার সাথে মেজর জলিলের কথা হয়। তাদের মধ্যে কী কথা হয়, সেটা কেউ অনুমান করতে পারেননি।

ভোরবেলা দেখতে দেখতে সেপাইদের বিদ্রোহের ঢেউ ১০ম বেঙ্গলেও লাগতে শুরু করে। সেপাইরা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। পরিস্থিতি কর্নেল নওয়াজিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তারা খালেদ ও তার সহযোগীদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। সেপাইরা তাদের টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনেন।

ইউনিটের অফিসার মেজর আসাদের বিবৃতি অনুসারে কর্নেল হায়দারকে তার চোখের সামনেই মেস থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে এনে প্রকাশ্যে সৈনিকরা গুলি করে হত্যা করে। বাকি দুজন উপরে ছিলেন, তাদের কীভাবে মারা হয় তিনি দেখতে পাননি।

একাধিক ভাষ্যে জানা যায় খালেদ মোশাররফ, হায়দার ও হুদা অফিসার মেসে বসে সকালের নাস্তা করছিলেন। হুদা ভীত হয়ে পড়লেও খালেদ ছিলেন ধীর, স্থির, শান্ত। তিনি হুদাকে সাহস রাখতে বলেন।

মেজর জলিল কয়েকজন উত্তেজিত সৈনিক নিয়ে মেসের ভেতর প্রবেশ করে। তার সাথে একজন বিপ্লবী হাবিলদারও ছিলেন। ওই হাবিলদার চিৎকার দিয়ে জেনারেল খালেদকে বলেন, ‘আমরা তোমার বিচার চাই।’

খালেদ শান্ত কণ্ঠে জবাব দেন, ‘ঠিক আছে, তোমরা আমার বিচার করো। আমাকে জিয়ার কাছে নিয়ে চলো।’

স্বয়ংক্রিয় রাইফেল বাগিয়ে ওই হাবিলদার চিৎকার করে বলেন, ‘আমরা এখানেই তোমার বিচার করব।’

খালেদ ধীর-স্থির। বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমরা আমার বিচার করো।’

খালেদ দু’হাত দিয়ে তার মুখ ঢাকলেন।

এরপর ওই হাবিলদারের ব্রাশফায়ারে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী খালেদা মোশাররফ।

কামরার ভেতরেই গুলিবিদ্ধ হয়ে ধরা পড়েন কর্নেল হুদা। সেখানেই তিনি প্রাণত্যাগ করেন। কর্নেল হায়দার ছুটে বেরিয়ে যান, কিন্তু সৈনিকদের হাতে বারান্দায় ধরা পড়েন। সেপাইরা তাকে কিল-ঘুষি-লাথি মারতে মারতে দোতলা থেকে নিচে নামিয়ে আনে। সেখানে একজন সৈনিকের গুলিতে তার মৃত্যু হয়। ঢাকায় পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বহু কমান্ডো আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কর্নেল হায়দার। ১৬ ডিসেম্বর একাত্তরে পল্টন ময়দানে ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ মুহূর্তে অপূর্ব ভঙ্গিতে স্টেনগান কাঁধে হায়দারকে দেখা যায় জে. অরোরা ও নিয়াজীর সঙ্গে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যেতে।

প্রকাশনা বন্ধ হওয়া আজকের কাগজ পত্রিকায় প্রত্যক্ষদর্শী মেজর আসাদুজ্জামান পরে ওইদিনের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে: ‘মেজর জলিল সাহেব উপরে (দোতলায়) ব্রিগেডিয়ার খালেদ, কর্নেল হুদা ও কর্নেল হায়দারের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। এর কিছুক্ষণ পরেই জোয়ানরা লে. কর্নেল হায়দারকে কিল, ঘুষি ও চড় মারতে মারতে নিচে নামিয়ে আনতে লাগল। আমি তখন বেশ দূরে একটা জিপের ভেতর ছিলাম। আমি জিপের দরজা খুলে বের হতেই তিনি আমাকে চিৎকার করে ডেকে বললেন, আসাদ সেভ মি। আমি দৌড়ে তার কাছে যেতে চেষ্টা করি। তার কাছে পৌঁছানোর পূর্বেই পাশে দাঁড়ানো এক জওয়ানের গুলিতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কতগুলো জওয়ান তাকে ঘিরে রাখল। চারিদিকে তখন গোলাগুলি চলছে।

‘এই পরিস্থিতিতে কে কী করল, তা ছিল খুবই অস্পষ্ট এবং ঘোলাটে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে কোনো অফিসারকেই সেদিন দেখতে পাইনি বা কাউকে এগিয়ে আসতেও দেখিনি। অন্য দুজন (খালেদ ও হুদা) কীভাবে মারা গেলেন তা স্পষ্ট বুঝতে পারিনি। মোটামুটি এই ছিল ৭ নভেম্বর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের একটি ইউনিটের খণ্ডচিত্র।’

এ বিভাগের আরো খবর