কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার বাইরে কাউকে ভোট দিতে না দেয়ার হুমকি দিয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা। নৌকাকে জেতাতে প্রয়োজনে একে-৪৭ অস্ত্রসহ সব ধরনের শক্তি খাটানোর হুমকিও দিয়েছেন তিনি।
হুমকি দেয়া আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মামুন বাজিতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
শুক্রবার বিকেলে বাজিতপুরের হুমাইপুর ইউনিয়নের টান গোসাইপুর গ্রামে হুমাইপুর ইসলামিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার মাঠে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় নৌকার চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী রফিকুল ইসলাম ধনু মিয়ার পক্ষে তিনি এ হুমকি দেন।
পরে সে জনসভার ৭ মিনিট ৯ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়।
‘আমাদের কুলিয়ারচর’ (Our Kuliarchar) নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে ৬ নভেম্বর রাত ২টা ৪৯ মিনিটে ভিডিওটি পোস্ট করা হয়।
ভিডিও পোস্টের কিছুক্ষণের মধ্যেই কয়েক হাজার রিঅ্যাক্ট পড়ে। মন্তব্য করেন হাজারের বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারী। আর দেড় হাজারেরও বেশি শেয়ার হয়।
মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম নামের একজন লেখেন, ‘তাহলে নির্বাচন দেয়ার দরকার কি? অযথা জনগণের টাকা নষ্ট না করে নৌকার প্রত্যেক প্রার্থীকে পরিষদে বসিয়ে দিলেই হয়।’
ফারুক মিয়া নামের একজন লেখেন, ‘নৌকাকে পাস করাতে নয়, উনি এসেছেন নৌকাকে বাঁশ দিতে।’
শাহাবাজ আহাম্মেদ রুবেল নামের একজন লেখেন, ‘দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য এদের মতো একটা লোকই যথেষ্ট। লজ্জা লাগে আমাদের।’
সাদেকুর রহমান নবীন নামের আরেকজন লেখেন, ‘নৌকাকে ডুবাতে এমন একজন নেতার একটা বক্তৃতাই যথেষ্ট।’
এ ছাড়া যারা মন্তব্য করেছেন তাদের বেশির ভাগই এই নেতাকে গালমন্দ করেছেন। সমালোচনা করেছেন আওয়ামী লীগকে জড়িয়ে।
জনসভায় বক্তব্যের শুরুতে তিনি বলেন, ‘আপনারা যারা মেম্বার পদপ্রার্থী হয়েছেন, আপনাদের কাউকেই নৌকার বাইরে ভোট দেয়ার সুযোগ দেয়া হবে না।’
মঞ্চের টেবিলটা দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘নৌকার ভোট হবে এই রকম টেবিলের ওপরে, ওপেন। আপনারা যারা বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে মেম্বার প্রার্থী হয়েছেন, আপনারা আপনাদের জয়ের চেষ্টা করে মেম্বার প্রার্থী হন, মহিলারা মহিলা মেম্বার প্রার্থী হন, আমাদের কোনো আপত্তি নাই।
‘আমাদের নেতা-কর্মীরা কোনো বাধা দেবে না। কিন্তু আপনাদের এজেন্টের বলে দিবেন নৌকার ভোট কোনো কাইত্ব্যের (গোপনে) ভেতরে হবে না, নৌকার ভোট হবে টেবিলের মধ্যে সবার সামনে। এখানে যদি কোনো মেম্বার প্রার্থী বা তাদের এজেন্ট বিরোধিতা করেন, আমরা তাৎক্ষণিক সে প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেব।’
আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমরা সেদিন শুধু হুমাইপুরের শক্তি নিয়ে আসব না। আমাদের একে-৪৭ নাই, কিন্তু প্রয়োজনে সব নিয়ে আসব।’
আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘প্রশাসন আমাদের, পুলিশ বাহিনী আমাদের, সরকার আমাদের। আর কিছু কি বলার দরকার আছে? আমি কি আপনাদের খারাপ কিছু কইছি? কিন্তু কইলে এইডে আফনেরার লাইগ্যেই কইছি।’
বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, "এমপি সাহেবের চোখ লাল হয়ে আছে, আওয়ামী লীগের চোখ লাল হয়ে আছে। এখানে কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা যেন না ঘটে। ‘আমার কথাগুলো আগে ছিল এক রকম, কিন্তু নৌকা পুড়িয়ে ফেলার পরে হয়েছে আরেক রকম'।"
ভিডিওটিতে মামুনকে বলতে শোনা যায়, ‘কিছু মনে করবেন না, এগুলো না বললে নৌকার চেয়ারম্যান আমরা বানাতে পারব না।
‘এমপি সাহেবের মন খারাপ হয়ে আছে। আমি যা যা বলেছি, এইলার সমর্থন আছে। উনার ইঙ্গিতেই এইগুলো আমি বলেছি। এই জিনিসটা আদায় করতে আমরা অনেক কিছু দিতে প্রস্তুত। আপনারা ভয় পাবেন না।’
সবশেষে তিনি বলেন, ‘আমি এমপি সাহেবের পক্ষ থেকে এসেছি, শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে এসেছি।’
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের এমন বক্তব্যের পর পুরো ইউনিয়নের সাধারণ ভোটারদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। এতে নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ না হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হুয়াইপুর ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের একজন বাসিন্দা বলেন, ‘নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগেই এলাকার অবস্থা যে গরম। নির্বাচনের দিন না জানি কী হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘নিজেদের একটা মেম্বার প্রার্থী আছে, এই কারণে কেন্দ্রে না গিয়ে উপায় নাই৷ তা না হলে ঘরে বসে বসে সারা দিন টিভি দেখতাম।’
স্থানীয়রা জানান, হুমাইপুর ইউনিয়নের চৈতনপুর ও নামা গোসাইপুর গ্রামের মাঝখানের রাস্তায় একটি নৌকা বানিয়ে টানিয়েছিলেন নেতা-কর্মীরা।
বৃহস্পতিবার রাতে সেটি কে বা কারা পুড়িয়ে দেয়। পরে ওই ঘটনার প্রতিবাদে জনসভার আয়োজন করা হয়।
হুমাইপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা. মো. আরিফুজ্জামান সভায় সভাপতিত্ব করেন।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন ছাড়াও সভায় বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী রফিকুল ইসলাম ধনু মিয়া, উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. কবির হোসেন, বাজিতপুর পৌর আওয়ামী লীগ নেতা শওকত আকবর, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শফিউল হক, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি নাজমুল হোসাইনসহ অনেকে।
এমন বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে আব্দুল্লাহ আল মামুন নিউজবাংলাকে বলেন, তিনি এসব কথা বলেছেন।
মামুন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই হুমাইপুরে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। এ এলাকার মানুষ উন্নয়নের সুবিধা গ্রহণ করে ঠিকই, কিন্তু ভোট দেয় নৌকার বিপক্ষে। আবার আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীকও পুড়িয়ে দেয়। তাই এমন বক্তব্য দিয়েছি।’
কিশোরগঞ্জের পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সূত্র জানায়, বাজিতপুর পৌর শহরের আলোচিত সাচ্চু হত্যা মামলায় পিবিআই ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর মামুনকে গ্রেপ্তার করে। মামলাটিতে প্রায় চার মাস কারাভোগের পর জামিনে ছাড়া পান তিনি।
সম্প্রতি আদালতে মামলাটির অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পিবিআই। অভিযোগপত্রে হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা আসামি হিসেবে আব্দুল্লাহ আল মামুনের নাম রয়েছে।
দ্বিতীয় ধাপে ১১ নভেম্বর বাজিতপুর উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে ৮টিতে ভোটগ্রহণ হবে। তিনটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী থাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন তারা।