ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বরের তাৎপর্য তিন রাজনৈতিক দলের কাছে তিন রকম। বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর কাছে এটি জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস, জাসদের কাছে সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান দিবস আর আওয়ামী লীগের কাছে মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস।
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করেন স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকেই সেনাবাহিনীর একটি অংশে ক্রোধ দানা বাঁধতে থাকে। এই অংশের নেতৃত্বে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ।
নভেম্বরের শুরুতে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি অংশ অভ্যুত্থানে অংশ নেয়। বন্দি করা হয় তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে। এরপর সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব নেন খালেদ মোশাররফ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় সেনাবাহিনীর যে অংশটি জড়িত ছিলো তারা বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি। এক পর্যায়ে জেলখানায় হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। এর চারদিন পরই কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীতে হয়ে যায় পাল্টা অভ্যুত্থান।
পাল্টা অভ্যুত্থানে মুক্ত করা হয় জিয়াউর রহমানকে। আর দুই সঙ্গীসহ হত্যা করা হয় খালেদ মোশাররফকে।
ঢাকা সেনানিবাসে সে সময় দায়িত্ব পালন করা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন ‘বাংলাদেশ রক্তাক্ত অধ্যায় : ১৯৭৫-৮১’ বইয়ে লিখেছেন, ‘৭ নভেম্বর রাত ১২টার পর ঢাকা সেনানিবাস থেকে যখন সিপাহি বিপ্লবের সূচনা হয়, তখন খালেদ মোশাররফ ও অন্যরা বঙ্গভবনেই ছিলেন। এসব সংবাদ শুনে খালেদ মোশাররফ কর্নেল হুদার মাধ্যমে ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক নওয়াজেশের সঙ্গে যোগাযোগ করলে নওয়াজেশের ইউনিটে তাঁদের আসার জন্য বলা হয়।
কিন্তু সেটা পরে রটে যায় যে, তারা আরিচা হয়ে উত্তরবঙ্গের দিকে একটি বেসামরিক গাড়িতে যাওয়ার পথে আসাদ গেটের নিকট তাদের গাড়ি বিকল হয়ে পড়লে তারা নিকটস্থ একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে কাপড় বদলিয়ে ১০ ইস্ট বেঙ্গলের দিকে হেঁটে অধিনায়কের অফিসে পৌঁছায়। ভোরের দিকে জিয়াউর রহমান খালেদ মোশাররফের অবস্থান জানার পর তার সঙ্গে কথা বলেন এবং দুজনের মধ্যে কিছু উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। পরে জিয়াউর রহমান নওয়াজেশকে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলেন।’
তিনি লিখেছেন, ‘নওয়াজেশ সকালে তাদের জন্য নাশতার বন্দোবস্ত করে এবং তার বর্ণনামতে এ সময় খালেদ মোশাররফ অত্যন্ত স্বাভাবিক ও শান্ত ছিলেন। তবে কর্নেল হুদা ও হায়দার কিছুটা শঙ্কিত হয়ে উঠলে খালেদ মোশাররফ তাদেরকে স্বাভাবিক সুরে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে বলেন।’
‘ইতিমধ্যে সেনানিবাস থেকে কিছু বিপ্লবী সৈনিক ১০ ইস্ট বেঙ্গলের লাইনে এসে সেখানকার সৈনিকদের বিপ্লবের সপক্ষে উত্তেজিত করতে থাকে এবং খালেদ মোশাররফ ও তার সহযোগীদের হস্তান্তরের জন্য অধিনায়কের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। নওয়াজেশ উত্তেজিত সৈনিকদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এর কিছুক্ষণ পর কিছুসংখ্যক সৈনিক অধিনায়কের অফিসের দরজা একপ্রকার ভেঙে তিনজনকেই বাইরে মাঠে নিয়ে এসে গুলি করে হত্যা করে।’
অনেক ঐতিহাসিকের দাবি, এই পাল্টা অভ্যুত্থানের সাথে কর্নেল তাহেরের ঘনিষ্ঠ যোগ ছিলো। এই অভ্যুত্থানের পর পরিস্থিতির কেন্দ্রে চলে আসেন জিয়াউর রহমান। পরবর্তীতে ২৪ নভেম্বর কর্নেল তাহেরসহ জাসদ গণবাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে সামরিক আদালতে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। এর ৩৭ বছর পর ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে কর্নেল তাহেরের সেই বিচারকে অবৈধ ঘোষণা করে।
পরবর্তী সময়ে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন জিয়াউর রহমান। ১৯৮১ সালের মে মাসে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে তাকেও হত্যা করা হয়।
ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর উপলক্ষে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাসদ ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচি পালন করে থাকে।