দুবাই প্রবাসী নাইম খান ওরফে লোটাস মানব পাচার চক্রটির হোতা। চলতি বছরের মে মাসে দেশে আসেন তিনি। নাইমের প্রলোভনে কেউ রাজী হলে দুই থেকে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে তাদেরকে ভ্রমণ ভিসায় দুবাই নিয়ে যাওয়া হতো।
ভ্রমণ ভিসায় যাওয়ার পর কেউ কেউ সেখানে কাজের সুযোগ পেলেও অধিকাংশই কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এভাবে তিনি গত সাত বছরে পাঁচ শতাধিক বাংলাদেশিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে পাচার করেছেন।
শনিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন র্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল রাকিবুল হাসান।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থেকে মানব পাচার চক্রটির আট সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-৩।
গ্রেপ্তার করা হয় চক্রের হোতা নাইম খান ওরফে লোটাস ও সদস্য নুরে আলম শাহরিয়ার, রিমন সরকার, গোলাম মোস্তফা সুমন, বদরুল ইসলাম, খোরশেদ আলম, মো. সোহেল ও মো. হাবিবকে।
গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে ১৪টি পাসপোর্ট, ১৪টি নকল বিএমইটি (জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো) কার্ড, একটি সিপিইউ, একটি প্রিন্টার, একটি স্ক্যানার, দুই বক্স খালি কার্ড, পাঁচটি মোবাইল ফোন, একটি চেক বই, পাঁচটি নকল সিল জব্দ করা হয়।
তিনি বলেন, ভুক্তভোগীরা র্যাব-৩-এ অভিযোগ করেন যে, একটি চক্র তাদেরকে ভ্রমণ ভিসায় দুবাই পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভুক্তভোগীরা বিএমইটি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড ছাড়া অবৈধভাবে বিদেশ যেতে চান নাই এবং টাকা ফেরত চান। তখন মানব পাচারকারী চক্রটি নকল বিএমইটি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড তৈরি করে ভিকটিমদের দেয়।
নকল কার্ড নিয়ে ভুক্তভোগীরা বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন করতে গেলে বিমানবন্দরের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর সদস্যরা ভিকটিমদের ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড নকল হিসেবে শনাক্ত করেন এবং তাদের বিদেশ যাত্রা স্থগিত করেন। তখন ভিকটিমরা তাদের সংশ্লিষ্ট দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা কোন সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি এবং যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।
তিনি আরও বলেন, এরপর ভিকটিমের দেয়া অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব-৩ এর দল গোপন সংবাদের মাধ্যমে তুরাগ, উত্তরা, রমনা, পল্টন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় শনিবার রাত থেকে সকাল পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করে সংঘবদ্ধ মানব পাচার চক্রের আট সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।
জিজ্ঞাসাবাদে ও অনুসন্ধানে জানা যায়, নাইম খান ওরফে লোটাস চক্রের হোতা। তিনি দুবাই প্রবাসী। চলতি বছরের মে মাসে তিনি দেশে আসেন। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি পাশ। তিনি ২০১২ সালে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে দুবাই যায়। পরবর্তীতে দুবাই সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ থেকে শ্রমশক্তি আমদানি করা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু সেখানে শ্রম বাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাহিদা থাকায় দুবাইয়ের কিছু প্রতিষ্ঠান ভ্রমণ ভিসায় দুবাই অবস্থানকারীদের ওয়ার্কপারমিট দিয়ে কাজের বৈধতা দেয়।
এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নাইম মানব পাচারে জড়িয়ে পড়েন। তিনি দুবাইয়ে এবং বাংলাদেশে তার পরিচিতজনদের মাধ্যমে ভিকটিমদের উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে দুবাই যাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করে। ভিকটিম রাজী হলে দুই থেকে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে তিনি তাদেরকে ভ্রমণ ভিসায় দুবাই নিয়ে থাকেন। ভিকটিমরা ভ্রমণ ভিসায় যাওয়ার পর কেউ কেউ কাজের সুযোগ পেলেও অধিকাংশই কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এভাবে তিনি সাত বছর ধরে পাঁচ শতাধিক ভিকটিমকে দুবাই পাচার করেছেন।
জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, মানব পাচার থেকে অবৈধ উপার্জন দিয়ে নাইম দুবাইয়ে নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও রেসিডেন্স ভিসার অনুমোদন নেন। নাইমকে তার সহযোগিদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে জানায়, দুবাইয়ে ফারুক নামে তার একজন সহকারী রয়েছে এবং গ্রেপ্তারকৃত নুরে আলম শাহরিয়ার বাংলাদেশে তার মূল সহযোগী হিসেবে কাজ করে।
শাহরিয়ার ভিকটিমদের যাবতীয় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করে দিতেন। শাহরিয়ারের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় কম্পিউটার কম্পোজ ও ফটোকপির দোকান রয়েছে। সে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকেই ভিকটিমদের সঙ্গে যোগাযোগ করত। কিন্তু সাম্প্রতিককালে কিছু ভিকটিম বিএমইটি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড ছাড়া বিদেশ যেতে অস্বীকৃতি জানালে শাহরিয়ারের মাধ্যমে বিএমইটি কার্ড জালিয়াত চক্র মানব পাচার চক্রটির সঙ্গে জড়িত হয়।
কিভাবে নকল বিএমইটি কার্ড সরবরাহ করে
লে. কর্নেল রাকিবুল হাসান বলেন, বিএমইটি কার্ড জালিয়াত চক্রের হোতা হাবিব এবং খোরশেদ। তারা দীর্ঘদিন ধরে অত্যন্ত গোপনে নিজেদের আড়ালে রেখে বিশ্বস্ত জনের মাধ্যমে ভিকটিমদের নকল বিএমইটি কার্ড সরবরাহ করে আসছেন। দীর্ঘদিন ধরে নাইম বিএমইটি কার্ড ছাড়াই মানবপাচার করে আসছেন। ভিকটিমরা বিএমইটি কার্ড দাবী করলে শাহরিয়ার তার চাচা গ্রেপ্তারকৃত গোলাম মোস্তফা সুমনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখন সুমন জানান ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে সে একটি বিএমইটি কার্ড দিতে পারবেন। নাইম ভিকটিমদের বিএমইটি কার্ড সংগ্রহ করার জন্য শাহরিয়ারের মাধ্যমে ১৩টি পাসপোর্ট সুমনের কাছে হস্তান্তর করে।
তিনি আরও বলেন, সুমন সাত হাজার টাকার বিনিময়ে একটি বিএমইটি কার্ড হিসেবে পাসপোর্ট বদরুলের কাছে হস্তান্তর করেন। বদরুল এক হাজার টাকার বিনিময়ে একটি বিএমইটি কার্ড হিসেবে পাসপোর্ট খোরশেদের কাছে হস্তান্তর করেন। খোরশেদ ৬৫০ টাকার বিনিময়ে একটি বিএমইটি কার্ড হিসেবে পাসপোর্ট হাবিবের কাছে হস্তান্তর করে। হাবীব পাসপোর্টের তথ্য ব্যবহার করে জাল বিএমইটি কার্ড তৈরি করেন। এরপর জাল বিএমইটি কার্ড খোরশেদ ও বদরুলের হাত হয়ে সুমনের কাছে পৌঁছায়। রিমন সরকার শাহরিয়ারের নির্দেশে জাল বিএমইটি কার্ড সুমনের কাছ থেকে সংগ্রহ করে নাইমের কাছে পৌঁছে দেন। নাইম ফ্লাইটের আগে ভিকটিমদের কাছে জাল বিএমইটি কার্ড সরবরাহ করেন। সোহেল স্থানীয় দালাল হিসেবে কাজ করেন।
জাল বিএমইটি কার্ড তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে হাবিব জানায়, সে মহসিন নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে খালি কার্ড কিনতেন। প্রকৃত বিএমইটি কার্ড স্ক্যান করে সে নিজেই গ্রাফিক্স তৈরি করত। তারপর ভিকটিমের পাসপোর্টে দেয়া তথ্য অনুযায়ী কার্ডের পিছনে তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয় এবং বদরুলের নির্দেশমত রিক্রুটিং লাইসেন্সের নম্বর বসিয়ে দিত। সে চার বছর ধরে ভিজিটিং কার্ড, আইডি কার্ডের ডিজাইন এবং প্রিন্টের ব্যবসা করে আসছেন। অভিজ্ঞতা থেকে সে কাস্টমারদের চাহিদা অনুযায়ী অর্থের বিনিময়ে সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নকল কার্ড তৈরি করে সরবরাহ করে আসছেন।