অপরাধ তদন্তের ভাষায় নিখুঁত খুন বা পারফেক্ট মার্ডার হলো সেই হত্যাকাণ্ড, যার কোনো কিনারা করা যায় না। হত্যাকারী এমন নিখুঁতভাবে হত্যাকাণ্ডের সব আলামত মুছে ফেলতে পারেন যে, তদন্তকারীরা হত্যাকারীর নাগাল পান না।
রাজধানীর কলাবাগানে ভাড়া বাসায় চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমান হত্যাকাণ্ডও সে রকমই একটি ‘নিখুঁত খুনে’ পর্যবসিত হতে যাচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কেননা হত্যাকাণ্ডের পাঁচ মাসেও পুলিশ এটির কোনো কিনারা করতে পারেনি।
তিনটি ফরেনসিক প্রতিবেদন নিয়ে কাজ করছে পুলিশ। এখান থেকে মৃত্যুর কারণ জানা গেলেও হত্যাকারী সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি।
থানা পুলিশ রহস্য উদঘাটনে কোনো অগ্রগতি করতে না পারায় তদন্তের দায়িত্ব পায় বিশেষায়িত তদন্ত সংস্থা পিবিআই। দায়িত্ব পাওয়ার পর এখন ফরেনসিক প্রতিবেদন নিয়ে পর্যালোচনা করছে এটির তদন্তকারীরা।
গত ৩১ মে সকালে কলাবাগান ফার্স্ট লেনের ৫০/১ নং বাড়ির তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে গ্রিনলাইফ হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের চিকিৎসক সাবিরা রহমানের রক্তমাখা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক জুয়েল মিয়া বলেন, ‘মামলার কাজ চলমান। এখন পর্যন্ত ক্লুলেস। সন্দেহের তালিকায় অনেকে থাকলেও আমরা এখনও নির্দিষ্ট করতে পারি নাই। প্রতিটি সাইট আমরা নক করছি। প্রতিটি বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আবার রিশাফল করছি। নতুন করে সবাইকে আমরা আবার জিজ্ঞাসাবাদ করছি। কাজ চলছে, তবে আসামি ধরার মতো অগ্রগতি এখনও হয় নাই।’
চিকিৎসক সাবিরার বাসা থেকে নানা আলামত সংগ্রহ করছে পুলিশ
ফরেনসিক প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘ফরেনসিক প্রতিবেদনগুলো সংগ্রহ করেছি আমরা। ফরেনসিক প্রতিবেদনে এসেছে, প্রথমে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এরপর আগুন লাগানো হয়েছে। এই আগুনে সাবিরার শরীরের ৭০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ৯টি কোপ দেয়া হয়েছিল।
‘আগুন জ্বালাতে দাহ্য পদার্থের যে কথা বলা হচ্ছিল, এ ধরনের কোনো পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। ফরেনসিক প্রতিবেদনে ধর্ষণের কোনো আলামতও পাওয়া যায়নি।’
পিবিআই তদন্তকারীরা জানান, ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য যেসব সংস্থা এর সঙ্গে যুক্ত ছিল, সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ঘটনাস্থলের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ফোনের সংযোগে কোনো কিছু ঘটেছে কি না, সব খুঁটিনাটি দেখা হয়েছে।
সাবিরার কক্ষে ঢুকে তাকে খুন করা হয়েছে বেশ নিখুঁতভাবে। পেছন থেকে ছুরিকাঘাতের বড় ক্ষত ছিল কাঁধ ও ঘাড়ের মাঝামাঝি জায়গায়। পরে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। খুনি কোনো আলামত রেখে যায়নি। তদন্ত এগিয়ে নেয়া যায়, এমন একটি ক্লুও খুঁজে পায়নি পুলিশ।
কলাবাগানের ভাড়া বাসায় একটি কক্ষে ডা. সাবিরা থাকতেন একা। তিন কক্ষের ফ্ল্যাটে সাবলেট হিসেবে ভাড়া দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই তরুণীকে। এদের একজন ঈদের ছুটিতে বাড়ি গিয়ে আর ফেরেননি তখনও। অন্যজন একজন মডেল, যিনি ভোরে জগিংয়ের জন্য বের হন।
সেই বাড়িতে একজন দারোয়ান ছিলেন, কিন্তু কারা নিচ থেকে উঠেছেন, খুন করে চলে গেছেন, তিনি দেখেননি বলে জানিয়েছেন।
ওই বাড়িতে কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না। আর ডা. সাবিরার কক্ষে কারও আঙুলের ছাপও পাননি তদন্ত কর্মকর্তারা।
শুরু থেকেই ঘুরপাক খাওয়া তদন্ত কর্মকর্তারা একে ‘একটি নিখুঁত খুন’ হিসেবেই দেখছিলেন। সেই বাসায় সাবলেট থাকা নারী মডেলের কাছ থেকে কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি। আর তাকে সন্দেহ করার মতো কোনো উপাদানও পায়নি পুলিশ। পরে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমানকে এই কক্ষে ছুরিকাঘাত করে হত্যার পর মরদেহে আগুন দেয়া হয়। ছবি: নিউজবাংলা
যেভাবে ঘটনা জানতে পেরেছিল পুলিশ
সাবিরার মৃতদেহ উদ্ধারের পর ওই দিনের বর্ণনা দিয়ে কলাবাগান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পরিতোষ চন্দ্র ঠাকুর নিউজবাংলাকে বলেছিলেন, ‘সাবিরার পাশের রুমে একজন মডেল থাকতেন। তিনি ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগ থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছেন। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মেয়েটি এই বাসায় সাবলেটে ওঠেন।
‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জেনেছি, সেই মডেল সকাল ৬টা ১০ মিনিটের দিকে ধানমন্ডি লেকে হাঁটতে যান। সকাল আনুমানিক ৯টা ৪০ মিনিটে বাসার প্রধান গেট খুলে ভেতরে ঢুকে ধোঁয়া এবং পোড়া গন্ধ পান তিনি। তিনি তখন বাসার দারোয়ানকে জানান। এরপর ফ্ল্যাটের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা আরেক নারীকে জানান।
‘লোক জানাজানি হলে বাসার পাশের এক মিস্ত্রিকে এনে রুমের দরজার লক খুলে ভেতরে গিয়ে দেখেন ভেতরটা ধোঁয়াচ্ছন্ন। যারা আসছিল তখন তারা আগুন মনে করে পানি মারে। এর পর তারা ফায়ার সার্ভিসকে ফোন দিয়েছে বলে জানায়। আর পুলিশ পরে খবর পায়,’ যোগ করেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা।
প্রথমে ওই বাসায় যায় কলাবাগান থানা পুলিশ। পরে তারা খবর দেয় সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটকে। পরে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন ডিবি, র্যাব, তদন্ত সংস্থা পিবিআইয়ের সদস্যরা।