কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। মাদারীপুর-৩ আসনের এই সংসদ সদস্য নিজ বাড়িতে অবস্থান করে আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থীদের দিকনির্দেশনা দেয়া ও প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ করেছেন স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীরা।
এমপির বিরুদ্ধে কালকিনি ও ডাসার উপজেলার ১২ ইউনিয়নের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। বৃহস্পতিবার ১০ জন ও শুক্রবার আরো ২ জন প্রার্থী পৃথকভাবে অভিযোগ দাখিল করেন। এমপি এলাকায় থাকায় দলীয় লোকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মারধর করছে, এমন অভিযোগ এনে মাদারীপুর আদালত ও থানায় কয়েকটি মামলাও হয়েছে।
এ বিষয়ে কালকিনির নির্বাচন কর্মকর্তা কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অভিযোগ ও সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, নির্বাচনি আচরণবিধির ২৫ (১) ধারা অনুযায়ী নির্বাচন-পূর্ব সময়ে কোনো সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে রাজস্ব বা উন্নয়ন তহবিলভুক্ত কোনো প্রকল্পের অনুমোদন, ঘোষণা বা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন কিংবা ফলক উন্মোচন করা যাবে না। এমপি আবদুস সোবহান গোলাপ এই বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে এনায়েতনগর ও পূর্ব এনায়েতনগর ইউনিয়নে কয়েকটি উন্নয়নমূলক কাজের ফলক উন্মোচন করেন।
একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থীর অভিযোগ, এমপি গোলাপের বাড়ি উপজেলার রমজানপুর ইউনিয়নেও নির্বাচন হচ্ছে। তিনি এলাকায় অবস্থান করায় ১৩টি ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী ও কর্মীরা স্বতন্ত্র ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থকদের নির্বাচনি প্রচারে বাধা দিচ্ছেন। এই বাধাদান ও মারধরের প্রতিবাদে কালকিনি থানা ও মাদারীপুর আদালতে তারা মামলা করেছেন।
কয়ারিয়া ইউনিয়নের তোফায়েল আহমেদ টিটন ও কামরুল হাসান নুর মোহাম্মদ মোল্লা, সাহেবরামপুরের মাহবুবুর রহিম, সিডিখানের মিলন মিয়া, শিকারমঙ্গলের এম এ কুদ্দুস ও সিরাজুল হক, গোপালপুরের ফরহাদ মাতুব্বরসহ একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী বলেন, ‘আমাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন, নির্বাচনি প্রচারে বাধাদান, ঘরবাড়ি ভাঙচুর, পোস্টার-ব্যানার ছিঁড়ে ফেলা এবং এমপি গোলাপের আচরণবিধি লঙ্ঘনসহ বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করে আমরা রিটার্নিং অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছি। কিন্তু এখনও কোনো প্রতিকার পাইনি। আসন্ন ইউপি নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানে উদ্যোগ গ্রহণে আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি।’
কালকিনি উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং কর্মকর্তা দীপংকর বিশ্বাস বলেন, ‘নির্বাচনি এলাকায় সংসদ সদস্যদের থাকার বিধান নেই। তবে এমপি যদি ব্যক্তিগত কাজে আসেন তাহলে থাকতে পারবেন। কিন্তু কোনো অবস্থায়ই নির্বাচনি প্রচারে অংশ নিতে পারবেন না। মাদারীপুর-৩ আসনের এমপির বিরুদ্ধে কয়েকজন প্রার্থী অভিযোগ দিয়েছেন। তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপিকা তাহমিনা বেগম বলেন, ‘আমরা কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নই। ইদানীং কালকিনিতে আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে যা হচ্ছে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, তারা সবাই আওয়ামী লীগের ভোটার। এখানে জোরজুলুমের কোনো সুযোগ নেই। বর্তমান এমপি কেন্দ্রীয় বড় নেতা। তার বিষয়ে আমি তেমন কিছু বলতে চাই না।’
মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) চাইলাউ মারমা বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কয়েকটি ইউনিয়নে বিচ্ছিন্ন ঘটনায় পুলিশ মোতায়েন করা আছে। ভোট গ্রহণ পর্যন্ত আমাদের কঠোর অবস্থান থাকবে।’
অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও এমপি গোলাপের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।
তবে কালকিনি উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর গোলাম ফারুক বলেন, ‘এমপি তার ব্যক্তিগত কাজে বাড়িতে এসেছেন। আর তিনি যে ইউনিয়নে উন্নয়নকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন, সেখানে নির্বাচন হচ্ছে না। তিনি কোনো নির্বাচনি জনসভায়ও যোগ দেননি। কিছু প্রার্থী গিয়ে তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেছেন। এটা দোষের কিছু নয়।’
নিজ বাড়িতে অবরুদ্ধ স্বতন্ত্র প্রার্থী
কালকিনি উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী হাফিজুর রহমান মিলন সরদারের বাড়িঘরে হামলা ও তাকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ উঠেছে।
হাফিজুর রহমান মিলন শুক্রবার নিজ বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন করে এই ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী সাহীদ পারভেজের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনেন। বাড়িতে অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, কালকিনি থানার ওসি বিষয়টি নিয়ে পক্ষপাতিত্ব করছেন।
হাফিজুর রহমান মিলন বলেন, ‘নৌকা প্রতীকের প্রার্থী সাহীদ পারভেজ কর্মী-সমর্থক নিয়ে গত ২৮ অক্টোবর হত্যার উদ্দেশ্যে আমার বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ১০টি মোটরবাইক, একটি প্রাইভেট কারসহ কোটি টাকার ক্ষতিসাধন করেন। আমি অবরুদ্ধ থাকায় ভাইকে দিয়ে কালকিনি থানায় মামলা করতে গেলে থানার সামনে নৌকার পক্ষের লোকজন বাধা দেয়। পরে আমি আদালতে মামলা করি। এখন বাড়িতে অবরুদ্ধ হয়ে আছি। পুলিশ প্রশাসনও আমাকে কোনো সহযোগিতা করছে না।’
অভিযোগের বিষয়ে সাহীদ পারভেজ বলেন, ‘মিলন সরদারের অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আলীনগরবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তিনি লোকজন নিয়ে আমার নির্বাচনি ক্যাম্পের নৌকা প্রতীক ভাঙচুর এবং প্রধানমন্ত্রীর ছবি ছিঁড়ে ফেলেছেন। আমার জয়ের সম্ভাবনা দেখে এখন কুৎসা রটাচ্ছেন। আমি তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব।’
অভিযোগের ব্যাপারে একাধিকবার কালকিনি থানার ওসি ইসতিয়াক আসফাক রাসেলকে ফোন করেও পাওয়া যায়নি। তবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) চাইলাউ মারমা বলেন, ‘তার (মিলন সরদার) বাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনায় মামলা দিতে বলেছি। কিন্তু তিনি থানায় মামলা দেননি। তারপরও তার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তা খতিয়ে দেখব।’