মা-বাবার ঝুলন্ত মরদেহের পাশে বসিয়ে শিশুসন্তানকে একজন সহকারী পুলিশ সুপারের জিজ্ঞাবাসাদের ঘটনায় তার দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে উঠে আসার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক এবং হবিগঞ্জের একজন আইনজীবী বলেছেন, দায়িত্বশীল কোনো পুলিশ কর্মকর্তা এই কাজটি করতে পারেন না।
ওই পুলিশ কর্মকর্তার নাম মহসিন আল মুরাদ। তিনি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট সার্কেলের এএসপি।
তার দাবি, শিশুটিকে সেখানে বসিয়ে কেবল নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করছিলেন। বাকি কথা বাইরে নিয়ে এসে বলেছেন। তবে অল্প সেই কথাইবা এমন পরিস্থিতিতে কেন বলতে হবে, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবী বলছেন, বাবা-মা হারানো শিশুটি এমনিতেই মানসিকভাবে চাপে ছিল। তাকে যত দ্রুত সম্ভব এমন পরিস্থিতি থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া উচিত ছিল। সেটি না করে পুলিশ কর্মকর্তা যেটি করেছেন, তা সেই শিশুর মনোজগতে চাপ তৈরি করবে।
শিশুটির বয়স ১০ বছর। তার ছোট ভাইয়ের বয়স ৬। তাদের বাড়ি চুনারুঘাটের নরপতি গ্রামে। বাড়িতে মা আলেয়া খাতুন, বাবা আব্দুর রউফ ও দাদা-দাদির সঙ্গে থাকত তারা।
অন্যান্য দিনের মতোই বৃহস্পতিবার রাতে খাবার খেয়ে মা-বাবার পাশের ঘরে ঘুমাতে চলে যায় দুই ভাই। শুক্রবার সকালে ঘুম থেকে উঠে দুই ছেলে পাশের ঘরে গিয়ে দেখে, মা ও বাবার দেহ ঝুলছে আড়ার সঙ্গে, একই দড়িতে।
তাদের চিৎকারে দাদা-দাদি ও প্রতিবেশীরা সেখানে যান। খবর পেয়ে থানার পুলিশ ও চুনারুঘাট সার্কেলের এএসপি মহসিন গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করেন।
মরদেহ উদ্ধারের আগে ওই কক্ষে স্থানীয় সংবাদকর্মীদের তোলা একটি ছবি পায় নিউজবাংলা। তাতে দেখা যায়, মা-বাবার ঝুলন্ত দেহের পাশে বিছানার ওপর বসিয়ে রেখে ১০ বছরের শিশুটির সঙ্গে কথা বলছেন সার্কেল এএসপি মহসিন।
নিউজবাংলায় এ ঘটনার সংবাদ প্রকাশ হলে ফেসবুকে শুরু হয় সমালোচনা। শিশুটির মানসিক অবস্থা বিবেচনা না করে মা-বাবার লাশের পাশে বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ অমানবিক বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে।
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য এসএসপি মহসিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘কীভাবে ঘটনাটি ঘটেছে তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে তারা (শিশুটির মা-বাবা) আত্মহত্যা করেছেন। এ ব্যাপারে আমরা দম্পতির দুই ছেলে ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছি। ঘরে বসে ছেলেদের সঙ্গে ৫ থেকে ৭ মিনিট কথা বলেছি। পরে বাইরেও দীর্ঘক্ষণ কথা হয়েছে।
‘এখানে (লাশের পাশে বসিয়ে) আমরা তাদের মা-বাবার মৃত্যু সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। তাদের মানসিক অবস্থা ঠিক রাখার জন্য কেবল নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করেছি।’
হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে সার্কেলের এএসপি মহসিন আল মুরাদ
কেন বাবা-মায়ের ঝুলন্ত মরদেহের পাশে শিশুকে তার নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করতে হবে- এমন প্রশ্ন করলে এএসপি মহসিন আবার বলেন, ‘কিছুক্ষণমাত্র কথা বলেছি।’
এ নিয়ে কথা বলতে জেলা পুলিশ সুপার এস এম মুরাদ আলীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি। পরে খুদে বার্তা দেয়া হলে তিনি ফিরতি বার্তায় জানান, তিনি ব্যস্ত; পরে কথা বলবেন।
হবিগঞ্জের আইনজীবী শাহ্ ফখরুজ্জামান এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি সামাজিক এবং আইনের দৃষ্টিতে খুবই অমানবিক। মা-বাবার মরদেহের পাশে এই শিশুদের সঙ্গে কথা বলা ঠিক হয়নি। এতে তাদের মনোজগতে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়তে পারে। এ বিষয়ে অবশ্যই আরও সতর্ক থাকতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান এবং সহকারী অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এভিডেন্স অ্যাক্ট অনুযায়ী, শিশু মামলায় জড়িত হতে পারে। তবে শর্ত হলো, তার কথা মানুষের বুঝতে পারতে হবে এবং সে যে ঘটনাটা বুঝছে সেই মেসেজটা তার থাকতে হবে।
‘যদি কোনো পুলিশ অফিসার মা-বাবার মরদেহের পাশে বসিয়ে শিশুসন্তানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, তাহলে আমি মনে করি সেটি যথাযথ প্রসিকিউরডভাবে হয়নি। যেহেতু শিশুটির মা-বাবা মারা গেছে, তার মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে পুলিশের উচিত ছিল তাদের সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং দিয়ে চাইল্ড-ফ্রেন্ডলি পরিবেশে জিজ্ঞাসাবাদ করা।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নাফিজা ফেরদৌসী বলেন, ‘ছেলেটা পড়ালেখা চালিয়ে নিতে পারবে কি না, এখন তাদের কে দেখাশোনা করবে, সব মিলিয়ে তাদের সামনে অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থা। ছেলেটা এখন চরম শোকের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে যখন আবার কেউ এসব বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে তখন তার বিষয়গুলো বার বার মনে পড়বে। এ ধরণের ঘটনায় একটি শিশু মানসিক বিপর্যয়ের দিকে যেতে পারে।’
মৃত দম্পতির পরিবারের সদস্যরা জানান, আব্দুর রউফ ছিলেন রিকশাচালক। তার স্ত্রী আলেয়া দীর্ঘদিন সৌদি আরব ছিলেন। এক মাস আগে তিনি দেশে ফিরে আসেন। এর পর থেকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ লেগে থাকত।
এ কারণে তারা দুজন আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন বলে ধারণা স্বজনদেরও।
তাদের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে জানান ওসি চম্পক। তিনি আরও জানান, ওই শিশুরা বাড়িতেই দাদা-দাদির কাছে আছে।