ফেনীর পরশুরামে নির্বাচন মানেই যেন বিনা ভোটে জয়। এ উপজেলায় সবশেষ নির্বাচিত সব জনপ্রতিনিধিই ভোট ছাড়া জয় পেয়েছেন।
উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের কোনোটাতেই ভোট হয়নি। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
এ বছরও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিপক্ষে যারা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করছেন, তাদের ওপর হামলা এবং মারধরের অভিযোগ উঠেছে। অন্যবার আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি-জামায়াত থাকলেও এবার আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী যেন শুধুই তারা। নিজ দলের কর্মীদের হাতেই হামলা ও মারধরের শিকার হচ্ছেন প্রার্থীরা।
উপজেলা নির্বাচন কার্যালয় থেকে জানা যায়, চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি পরশুরাম পৌরসভায় নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। তবে ভোটের আগেই মেয়র, কাউন্সিলর, মহিলা কাউন্সিলর সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
একই পৌরসভায় ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনেও মেয়র, কাউন্সিলর ও মহিলা কাউন্সিলররা সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন।
২০১৯ সালের মার্চে পরশুরাম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও ভোট হয়নি। চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানরা জয় পান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।
২০১৬ সালের মার্চে পরশুরাম উপজেলার তিনটি ইউপিতে (বক্সমাহমুদ, মির্জানগর ও চিথলিয়া) ভোট হওয়ার কথা ছিল। তবে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে না পারায় ভোট স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন। এরপর একই বছরের ৩১ অক্টোবর ভোটের তারিখ দেয়া হয়। তবে আওয়ামী লীগের সব প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
এই বছর তৃতীয় ধাপে ইউপি নির্বাচনে পরশুরামের বক্সমাহমুদ, মির্জানগর ও চিথলিয়া ইউনিয়নে তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র সংগ্রহও করেছেন। তবে দেখা গেছে সেই পুরোনো চিত্রই।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছাড়া এখনও কেউ মনোনয়নপত্র জমা দেননি। এর মধ্যে শুরু হয়েছে নৌকার প্রার্থী ছাড়া বাকিদের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর। জোর করে মনোনয়নপত্র ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগও উঠেছে। এমনকি দলের সিদ্ধান্তের বাইরে প্রার্থী হওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের হাতেই হেনস্তার শিকার হয়েছেন অনেকে।
বক্সমাহমুদ ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সহসভাপতি জাকির হোসেনের ওপর ২৪ অক্টোবর রাতে হামলা এবং তার কাছ থেকে মনোনয়নপত্র ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টার অভিযোগ ওঠে।
জাকির অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল গফুরের বিপরীতে প্রার্থী হওয়ায় তার বাড়িঘরে হামলা করা হয়েছে। এ ঘটনায় পরশুরাম থানায় ২৪ অক্টোবর রাতে মামলাও করেছেন। মামলায় মো. জনি নামের একজনকে প্রধান আসামি করে ৬ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১০ থেকে ১৫ জনকে আসামি করা হয়।
এজাহারে বলা হয়, ২৪ অক্টোবর রাত সাড়ে ১০টার দিকে মনোনয়নপত্র নিয়ে স্ত্রীসহ বাড়িতে যাচ্ছিলেন জাকির। পথে গুথুমা তাজুলের বাড়ির সামনে গেলে জনি, রনি, ইয়াছিনসহ ১৫ থেকে ২০ জন তাদের বহনকারী সিএনজিচালিত অটোরিকশার গতিরোধ করে। সেখানে তাকে মারধর করা হয়। কিছুক্ষণ পর তার বাড়িতে গিয়েও হামলা চালানো হয়।
জাকির গত বছর আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেলেও এবার পাননি। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জন্য মনোনয়নপত্র কেনেন।
হামলার ঘটনায় জাকির পরশুরাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন চৌধুরী সাজেলকে দায়ী করেন। সাজেল পরশুরাম পৌরসভায় বিনা ভোটে নির্বাচিত মেয়র।
ঘটনার রাতে পুলিশ উদ্ধার করার পর মামলা করেন জাকির। তবে ঘটনার ২৪ ঘণ্টা না যেতেই জাকির তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল গফুরের পক্ষে কাজ করার ঘোষণা দেন।
এ বিষয়ে জাকিরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে কিচ্ছু বলতে চাই না। সাংবাদিকরা আপনারা বুঝে নেন।’
নাম না প্রকাশ করার শর্তে তার শুভাকাঙ্ক্ষী ও আওয়ামী লীগের এক কর্মী বলেন, ‘জাকির ভাই জীবন বাঁচানোর তাগিদে ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। তাকে অব্যাহতভাবে জীবননাশের হুমকি দেয়া হচ্ছে।’
তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল গফুর বলেন, ‘আমরা ভাই-ভাই এক। আমাদের মধ্যে কোনো হিংসা-বিরোধ নেই। ওই দিনের ঘটনা সামান্য ভুল-বোঝাবুঝি।’
এ বিষয়ে জানতে পরশুরাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন চৌধুরী সাজেলের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি।
এ ছাড়া মির্জানগর ইউনিয়ন পরিষদে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী ও ফেনী জেলা যুবলীগের সদস্য ফখরুল ইসলাম ফারুক তার বাড়িতে ২৩ অক্টোবর হামলার অভিযোগ করেন।
তিনি বলেন, ‘মির্জানগর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান হিসেবে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে দলের ধানমন্ডি কার্যালয়ের সামনে ২৩ অক্টোবর মানববন্ধন করি। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান মো. নুরুজ্জামান ভুট্টোর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করায় ক্ষিপ্ত হয়ে আমার বাড়িতে হামলা করে। আমি বর্তমানে এলাকা ছাড়া।’
তিনি অভিযোগ করেন, ইউনিয়নের আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী এমরান হোসেনের কাছ থেকে মনোনয়নপত্র জোর করে ছিনিয়ে নিয়েছেন ভুট্টোর সমর্থকরা।
এ বিষয়ে নুরুজ্জামান ভুট্টো বলেন, ‘এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। আমি এসবের কিছুই জানি না।’
চিথলিয়া ইউনিয়ন পরিষদে স্বতন্ত্র প্রার্থী আমিনুর রহমান মিলনকে বর্তমান চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিনের ভাই ইউছুফ ও ফারুক নানা হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
হুমকির অভিযোগ করে মিলন বলেন, ‘আমি হাল ছেড়ে দেয়ার লোক নই।’
পরশুরাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খালেদ হোসেন বলেন, ‘একজন স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনায় তিনি বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন। অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
‘আর নির্বাচনকে সামনে রেখে সব প্রার্থীকে সমান নিরাপত্তা দেয়া হবে। আমাদের কাছে অভিযোগ এলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেব।’
তৃতীয় ধাপে পরশুরামের তিন ইউপিসহ দেশের ১ হাজার ৭টি ইউপিতে ভোট হবে আগামী ২৮ নভেম্বর।