সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিক্রিতে। এর ফলে এ খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণও কমতে শুরু করেছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এ খাত থেকে ৮ হাজার ৫৫৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। গত বছরের একই সময়ে নিয়েছিল ১১ হাজার ৬০৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এ হিসাবে এই তিন মাসে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ কমেছে ২৬ দশমিক ২৭ শতাংশ।
সঞ্চয়পত্র খাতে সরকারকে যাতে বেশি সুদ পরিশোধ করতে না হয়, সে জন্য বিক্রি কমাতে গত ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্রের সুদের ২ শতাংশের মতো কমিয়েছে সরকার।
তার প্রভাব বিক্রিতে পড়তে শুরু করেছে। আর এতে সরকারের ভবিষ্যৎ ঋণের বোঝা লাঘবের পথ মসৃণ হলো বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক জায়েদ বখত।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, মুনাফার হার কমানোয় সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ আগামী দিনগুলোতে আরও কমবে। এক ধরনের স্বস্তিতে থাকবে সরকার।
রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বলেন, ‘সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর সুদের হার কমানো ছাড়া সরকারের আর কোনো উপায় ছিল না। গত অর্থবছরে সুদ-আসল বাবদ সরকারকে ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে। এটা একটা বিশাল অঙ্ক; বাজেট থেকে সুদ-আসল বাবদ এত টাকা চলে গেলে অন্য কাজ কীভাবে হবে।
‘তাই আমি মনে করি সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে সরকার ঠিক কাজটিই করেছে। এখন বিক্রি আরও কমে আসবে; সরকারকে বেশি সুদ পরিশোধ করতে হবে না।’
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর বৃহস্পতিবার সঞ্চয়পত্র বিক্রির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর মাসে ২ হাজার ৮২৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ১৫২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এ হিসাবে এই মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ কমেছে ৩২ শতাংশ কম।
সব মিলিয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-আগস্ট) নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৫৫৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা। গত বছরের একই সময় বিক্রি হয়েছিল ১১ হাজার ৬০৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এ হিসাবে এই তিন মাসে নিট বিক্রির পরিমাণ কমেছে ২৬ দশমিক ২৭ শতাংশ।
এবারের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরেছে সরকার।
সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, সঞ্চয়পত্র থেকে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল সরকার। মূল বাজেটে এ খাত থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ধার করার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। বিক্রি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় ৩ জুন ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় সেই লক্ষ্য বাড়িয়ে ৩০ হাজার ৩০২ কোটি টাকা করা হয়।
কিন্তু বছর শেষে দেখা যায়, সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে মূল বাজেটের দ্বিগুণেরও বেশি ঋণ নিয়েছে। সংশোধিত বাজেটের চেয়ে বেশি নিয়েছে ৩২ শতাংশ। আর আগের অর্থবছরের চেয়ে বেশি নিয়েছে প্রায় তিন গুণ।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত অর্থবছরে মোট ১ লাখ ১২ হাজার ১৮৮ কোটি ২৪ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। এর মধ্যে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ ৭০ হাজার ২২৯ কোটি টাকা গ্রাহকদের পরিশোধ করা হয়। সে হিসাবে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা।
আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল গ্রাহকদের পরিশোধের পর যেটা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছিল ২০১৬-১৭ অর্থবছরে; ৫২ হাজার ৪১৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
সঞ্চয়পত্র খাতে সরকারকে যাতে বেশি সুদ পরিশোধ করতে না হয়, সে জন্য গত ২২ সেপ্টেম্বর সঞ্চয়পত্রের সুদের কমিয়ে দিয়েছে সরকার।
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এক রকম সুদের হার, ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এক রকম হার এবং ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরেক রকম হার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।
তবে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফার হারে সরকার হাত দেয়নি। অর্থাৎ আগে যে হারে সুদ পাওয়া যেত, এখনও সেই হারে পাওয়া যাবে।
এর আগে ২০১৫ সালের ২৩ মে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার গড়ে ২ শতাংশের মতো কমিয়েছিল সরকার।