উচ্চ আদালতের নির্দেশনা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসারে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বন্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলেছে হাইকোর্ট।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে তদারকি কমিটি করে বিষয়গুলো দেখভাল করতে বলেছে আদালত। এসব বিষয়ে মানুষকে সচেতন করাতে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করার পরামর্শও দিয়েছেন বিচারক।
বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ পর্যবেক্ষণ দেয়।
২০১৮ সালে কুমিল্লার বিপুলসার হাফিজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নোমান হোসেনকে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক এমদাদ হোসেন কর্তৃক শারীরিক নির্যাতনের প্রতিবেদনটি আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আব্দুল হালিম। পরে তার সঙ্গে পক্ষভুক্ত হয় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)।
বিষয়টি আমলে নিয়ে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের দ্বারা শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের ঘটনায় কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে। সেই রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় দেয় আদালত। সেখানে এ পর্যবেক্ষণ উঠে আসে।
ইতিপূর্বে আদালতের আদেশ নির্দেশনা থাকায় নতুন করে হাইকোর্ট আজ এ পরামর্শ দেয়।
আইনজীবী শারমিন আক্তার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বলেছে, যেহেতু উচ্চ আদালতের এ বিষয়ে রায় রয়েছে, মন্ত্রণালয়ের গাইডলাইনও আছে, এখানে নতুন করে যুক্ত করার কিছু নেই।
‘যেহেতু তারপরও বিভিন্ন সময় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে, সেহেতু মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আছে তাদের প্রতি আদালত পরামর্শ দিয়েছে যে, তারা যেন একটি মনিটরিং কমিটি করে। যাতে করে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা এবং মন্ত্রণালয়ের গাইডলাইন বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না তা মনিটরিং করে।’
২০১১ সালে হাইকোর্ট শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেয়ার বিষয়টি বেআইনি এবং অসাংবিধানিক ঘোষণা করে৷ উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সে সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্রও জারি করে।
এতে বলা হয়, হাত-পা বা কোনো কিছু দিয়ে আঘাত বা বেত্রাঘাত, শিক্ষার্থীর দিকে চক বা ডাস্টারজাতীয় বস্তু ছুড়ে মারা, আছাড় দেয়া ও চিমটি কাটা, কামড় দেয়া, চুল টানা বা চুল কেটে দেয়া, হাতের আঙুলের ফাঁকে পেনসিল চাপা দিয়ে মোচড় দেয়া, ঘাড় ধাক্কা, কান টানা বা উঠবস করানো, চেয়ার, টেবিল বা কোনো কিছুর নিচে মাথা দিয়ে দাঁড় করানো বা হাঁটু গেড়ে দাঁড় করিয়ে রাখা, রোদে দাঁড় করিয়ে বা শুইয়ে রাখা কিংবা সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড় করানো এবং ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে এমন কোনো কাজ করানো, যা শ্রম আইনে নিষিদ্ধ৷
এই পরিপত্রে শাস্তির কথাও বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেউ শিশুদের শারীরিক শাস্তি দিলে ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার পরিপন্থি হবে এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে৷
অভিযোগের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ১৯৮৫-এর আওতায় অসদাচরণের অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে৷ প্রয়োজনে ফৌজদারি আইনেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে৷
এই নির্দেশনা জারির পর স্কুলে শারীরিক শাস্তির প্রবণতা কমলেও বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসায় নির্যাতন বন্ধ হয়নি।
কওমি মাদ্রাসাগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণও করে না। আর এ কারণে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া কঠিন। আবার বেশ কিছু ঘটনায় দেখা গেছে, অভিভাবকরা আলেমদের বিরুদ্ধে মামলা করেন না পরকালের কথা ভেবে।
মাস কয়েক আগে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে সন্তানকে পিটুনির পর স্থানীয় প্রশাসন শিক্ষককে আটক করে নিয়ে এলেও নির্যাতিত শিশুর বাবা-মা-ই তাকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন। পরে সমালোচনার মধ্যে পুলিশ মামলা করে ওই শিক্ষককে গ্রেপ্তার করে।
বছর দুয়েক আগে চুয়াডাঙ্গায় একটি মাদ্রাসায় এক ছাত্রকে পিটিয়ে হাত ভেঙে দেয়ার পর শিশুটির বাবা মামলা করেও তা তুলে নেন। কারণ, স্থানীয় লোকজন তাকে বোঝান আলেমের বিরুদ্ধে মামলা চালালে আখেরাতের জন্য ভালো হবে না।
যে ঘটনায় উচ্চ আদালতে আবেদন করা হয়, সেটিও কওমি মাদ্রাসায় ঘটে। ২০১৮ সালে কুমিল্লার বিপুলসার হাফিজিয়া মাদ্রাসার ছাত্র নোমান হোসেনকে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক এমদাদ হোসেন শারীরিক নির্যাতন করেন বলে অভিযোগ ওঠে।
ঘটনাটি পত্রিকায় প্রকাশ হলে সেটি আদালতের নজরে আনা হয়। এরপর আদালত বিষয়টি আমলে নিয়ে শিক্ষক এমদাদ হোসেনের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে না, তার বিরুদ্ধে কেন মামলা করা হবে না, একই সঙ্গে ওই শিক্ষার্থীকে কেন চিকিৎসা দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়।