আলোর গতি শূন্যস্থানে ধ্রুবক। এটি পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম ভিত্তি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির একদল গবেষক একটি কম্পিউটার গেম ডিজাইন করেছেন, যেখানে আলোর গতি কমিয়ে এনে বিশেষ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া সম্ভব। তাদের গবেষণা ও গেমটি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট লাইভসায়েন্স। সেটি অবলম্বনে লিখেছেন রুবাইদ ইফতেখার।
এই বিশ্বজগতে সবচেয়ে দ্রুত ছুটে চলে আলো। শূন্যস্থানে আলোর গতি সেকেন্ডে ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল বা ৩ লাখ কিলোমিটার।
আলোর এই গতিকে যদি কমিয়ে আনা যায় কিংবা মানুষ যদি আলোর কাছাকাছি গতিতেও ছোটার সক্ষমতা অর্জন করে, তাহলে কী ঘটবে?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এমনটি সম্ভব হলে বদলে যাবে আমাদের চারপাশের পরিচিত অনেক বাস্তবতা। এমনকি যত গতি আপনি অর্জন করবেন, ততই দীর্ঘ হবে চলমান সময়। অর্থাৎ আলোর গতিতে ছোটা একজন ব্যক্তির বয়স অন্যদের চেয়ে বাড়বে ধীর গতিতে।
সুইজারল্যান্ডের জুরিখের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ইটিএইচের এজুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজির পরিচালক গার্ড কোর্টেমেয়ার ও তার সহকর্মীরা একটি কম্পিউটার গেম বানিয়েছেন। গেমটি খেলার সময় আলোর গতি কমে গেলে কেমন অবস্থা হতে পারে সেটির অভিজ্ঞতা অর্জন সম্ভব। গেমটি খেলার সময় আলোর গতিবেগ কমার কারণে রঙ ও উজ্জ্বলতার পরিবর্তনের মতো অদ্ভুত কিছু পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়। একইসঙ্গে বস্তুর স্বাভাবিক দৈর্ঘ্যেও পরিবর্তন দেখতে পান গেমাররা।
মানুষের মন্থর গতি
২০০৯ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ৯ দশমিক ৫৮ সেকেন্ডে ১০০ মিটার অতিক্রম করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন উসাইন বোল্ট। তার এই বিশ্বরেকর্ড এখন পর্যন্ত ভাঙতে পারেননি কেউ। তবে আলোর গতির তুলনায় বোল্টের এই গতি একেবারেই নগণ্য।
মানুষের তৈরি যে কোনো সর্বোচ্চ গতির যানের গতিবেগও আলোর তুলনায় অনেকটাই ধীর।
এমআইটি গেম ল্যাবের গবেষক ফিলিপ ট্যান বিজ্ঞানবিষয়ক সাইট লাইভ সায়েন্সকে বলেন, ‘আলোর গতির ০.০০৩৭ শতাংশ গতিতে মানুষ সর্বোচ্চ ছুটতে পেরেছে। আর এই গতি অর্জনও সম্ভব কেবল মহাকাশ যানে।’
মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিরও সহযোগী অধ্যাপক কোর্টেমেয়ার বলেন, ‘থট এক্সপেরিমেন্ট করে পদার্থবিদরা নির্ণয় করছেন আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে ছুটলে কী হতে পারে। আলবার্ট আইনস্টাইনের থিওরি অফ স্পেশাল রিলেটিভিটি দিয়ে গতি কীভাবে ভর, সময় ও স্থানকে প্রভাবিত করে তা ব্যাখ্যা করা যায়। এটি অনুযায়ী আমরা দ্রুত গতিতে কোনো বস্তুর পাশ দিয়ে ছুটে গেলে তার দৈর্ঘ্যের পরিমাপ ছোট হয়ে আসবে এবং আলোর অন্যান্য পরিবর্তনের মাঝে ডপলার এফেক্ট দেখা যাবে।
‘একই ধরনের পরিবর্তন দেখা যাবে যদি মানুষের গতিবেগ বাড়ানোর বদলে আলোর গতি কমিয়ে আনা হয়। দুটি ক্ষেত্রেই আমরা আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে ছুটতে পারব।’
আলো গতি যদি ধীর হতো
কোর্টেমেয়ার যখন এমআইটির ভিসিটিং প্রফেসর ছিলেন তখন একটি কম্পিউটার গেম তৈরি করেন, যেখানে আলোর গতিবেগ কমার ফলে প্রাত্যহিক জীবনে আপেক্ষিকতার প্রভাব কী হতো সেটার অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়। ২০১২ সালে তৈরি গেমটির নাম ‘আ স্লোয়ার স্পিড অফ লাইট’। এতে একজন খেলোয়াড় একটি চরিত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে, যে বিচ বলের মতো গোলক সংগ্রহ করে। ১০০টি গোলকের প্রতিটি সংগ্রহের সময় আলোর গতি কিছুটা হ্রাস পায়।
বাস্তবে অবশ্য গেমটির মতো করে আলোর গতি কমানো যায় না। কারণ, শূন্যস্থানে আলোর গতি বদলায় না ও পর্যবেক্ষকের অবস্থান থেকে এই গতি ধ্রুবক। কোর্টমেয়ারের মতে, আলো যে মাধ্যম দিয়ে অতিক্রম করে গতি তার ওপর নির্ভরশীল। তবে সেটি স্পেশাল রিলেটিভিটির প্রভাবকে বা আমরা প্রভাবগুলোকে যে ভাবে পর্যবেক্ষণ করি তাকে বদলে দেয় না।
আমরা যদি স্পেশাল রিলেটিভিটি পর্যবেক্ষণ করতে পারতাম তাহলে আলোর গতি গেরফেরে রঙ, সময়, দূরত্ব ও উজ্জ্বলতায় পরিবর্তন দেখা যেত। এমআইটির দলটি সে প্রভাবগুলোকেই গেমের মধ্যে আনার চেষ্টা করেছে।
রঙ্গের পরিবর্তন
মানুষের গতি যখন আলোর কাছাকাছি পৌঁছায় তখন আপেক্ষিক ডপলার এফেক্ট দৃশ্যমান হয়। এটা বোঝার আগে বুঝতে হবে যে আলোর কণা ও তরঙ্গ দুই বৈশিষ্ট্যই আছে। তরঙ্গ হিসেবে যখন আলো থাকে তখন এর বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা হয় তরঙ্গদৈর্ঘ্য দিয়ে। তরঙ্গের শীর্ষবিন্দু থেকে আরেক শীর্ষবিন্দু পর্যন্ত দূরত্ব পরিমাপ করে এর রঙ, কম্পাঙ্ক ও নির্দিষ্ট সময়ে কতগুলো শীর্ষবিন্দু তৈরি হলো সেটা বের করা যায়।
ডপলার এফেক্ট অনুযায়ী, কোনো শব্দের উৎসের দিকে এগোতে থাকলে এর কম্পাঙ্ক বা তীক্ষ্ণতা বাড়তে থাকে। কারণ কাছাকাছি গেলে তরঙ্গের শীর্ষবিন্দুগুলো কানের কাছে দ্রুতগতিতে আসতে থাকে। তবে আলোর উৎসের দিকে যেতে থাকলে তরঙ্গদৈর্ঘ্যগুলোকে ছোট মনে হয়। এতে করে আলোর রঙ নীল ও বেগুনি স্পেকট্রামের দিকে পরিবর্তিত হয়। অন্যদিকে আলোর দিক থেকে দূরে সরে যেতে থাকলে আলোর রঙ লাল স্পেকট্রামের দিকে পরিবর্তিত হতে থাকে। কোর্টমেয়ার বলেন, ‘এর ফলে আপনার দিকে আসতে থাকা বস্তু নীল মনে হয়, আর দূরে সরে যেতে থাকা বস্তু লাল মনে হতে থাকে।’
সময় ও দূরত্বে পরিবর্তন
স্পেশাল রিলেটিভিটির সবচেয়ে আলোচিত প্রভাবগুলোর একটি হলো, কেউ যদি আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে ছুটতে থাকে তখন সময় ধীর হয়ে আসে। তেমন পরিস্থিতিতে আলোর গতিতে ছুটতে থাকা ব্যক্তির বয়স বাড়বে ধীরগতিতে। এই প্রভাবকে বলা হয় টাইম ডাইলেশন।
ট্যান বলেন, ‘গেমটিতে আপনি এক ধরনের টাইম ডাইলেশনের অভিজ্ঞতা পাবেন; কিন্তু কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনা করা না হলে এর আসলে কোনো মানে নেই।
‘টাইম ডাইলেশন দেখা না গেলেও গেমটির শেষে খেলোয়াড়রা তাদের স্ক্রিনে একটা বার্তা পান যেখানে বলা হয়, ঘড়ির কাঁটায় প্রদর্শিত সময়ের চেয়ে কম সময় পার হয়েছে।’
স্পেশাল রিলেটিভিটির অন্যান্য প্রভাবের মতো গেমের মধ্যে টাইম ডাইলেশন হয় কারণ গেমের চরিত্রটি আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে ছুটতে থাকে।
স্পেশাল রিলেটিভিটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে ছুটতে থাকা বস্তুর বা স্থির বস্তুর পাশ দিয়ে আলুর গতিতে ছুটে যাওয়ার সময় ওই বস্তুর দৈর্ঘ্য সংকুচিত হয়ে আসে। একে বলে দৈর্ঘ্য সংকোচন। কোর্টমেয়ারের মতে, এই প্রভাবটি জটিল। স্থির পর্যবেক্ষকের পরিমাপে জায়গা থেকে আলোর গতিতে ছুটতে থাকা বস্তুকে দৈর্ঘ্য খাটো বা সংকুচিত মনে হতে পারে। আবার পর্যবেক্ষকের চোখে ওই বস্তুটি লম্বাও মনে হতে পারে। কোর্টমেয়ার বলেন, এর কারণ স্পেশাল রিলেটিভিটির একটি বিশেষ প্রভাব, যাকে বলা হয় রানটাইম এফেক্ট।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি বাইসাইকেল যদি আপনার দিকে এগোতে থাকে, তাহলে সাইকেলের সম্মুখভাগের আলো আপনার কাছে পশ্চাদ্ভাগের আলোর চেয়ে চোখে দ্রুত পৌঁছাবে। ফলে বাইক দূরে অবস্থান করার সময় এর সামনের অংশটিকে আপনি দেখবেন পেছনের তুলনায় সাম্প্রতিক অবস্থায়।
কোর্টমেয়ার বলেন, ‘পুরো প্রক্রিয়াটার কারণে বাইসাইকেলটিকে লম্বা মনে হয়।’ অনেক সময় একই কারণে কোনো কোনো বস্তুকে বিকৃতও মনে হতে পারে। অন্যভাবে বলা যেতে পারে, আলোর গতি যদি অনেক কমিয়ে দেয়া গেলে স্থির পর্যবেক্ষকের কাছে আলোর গতিতে ছুটতে থাকা কোনো বস্তুকে লম্বা বা বিকৃত মনে হতে পারে।
উজ্জ্বলতায় পরিবর্তন
বৃষ্টিতে হাঁটার সময় আমাদের সামনের দিকটি পেছনের দিকের চেয়ে বেশি ভিজে যায়। বৃষ্টিতে হাঁটার সময় দাঁড়িয়ে থাকার সময়ের চেয়ে বেশি বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে, তবে দেহের সামনের অংশ বাড়তি বৃষ্টি থেকে পেছনের অংশকে রক্ষা করে। কোর্টমেয়ার বলেন, আলোর গতিতে এগোতে থাকলে এমন ঘটনাই ঘটবে।
কারণ, আলো অনেক সময়েই কণার সমষ্টির মতো আচরণ করে। এই কণাগুলোকে বলা হয় ফোটন। এগুলো আসলে আলোর ফোঁটা। কম্পিউটার গেমটিতে কোনো বস্তুর দিকে এগোতে থাকলে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থানের চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল মনে হয়। এর কারণ আপনি ফোটনের দিকে হাঁটছেন। একে বলা হয় সার্চলাইট এফেক্ট।