ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর রাতে জাতীয় চার নেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেই কলঙ্কিত ইতিহাসের স্মৃতি ধরে রাখতে সেখানে তৈরি হচ্ছে জাতীয় চার নেতা স্মৃতি জাদুঘর।
পুরান ঢাকার পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারের ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’ সেল ঘিরে তৈরি হবে জাদুঘর। এতে থাকবে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানের ব্যবহৃত আসবাব, ঘাতকের বুলেটের চিহ্ন ধরে রাখা লোহার শিক ও অন্যান্য জিনিসপত্র। নেতাদের কর্মজীবন ছাড়াও ঐতিহাসিক তথ্যচিত্রগুলো রাখা হবে প্রদর্শনীর জন্য।
চার নেতার এই স্মৃতি জাদুঘর তৈরির কাজ আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে শেষ করে দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারটি ঐতিহাসিকভাবে সংরক্ষণের জন্য একটি নকশা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানার্সের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত এই প্রতিযোগিতায় ৩৪টি প্রতিষ্ঠান নকশা ও মডেল জমা দেয়। এর মধ্যে স্থাপনাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘ফর্ম থ্রি আর্কিটেক্টস’-এর নকশা সেরা হিসেবে নির্বাচিত হয়। সেই নকশাটি অনুযায়ী বাস্তবায়িত হচ্ছে পুরো কার্যক্রম।
ফর্ম থ্রি আর্কিটেক্টসের স্থপতি দিদারুল ইসলাম ভুঁইয়া জানান, কারাগারের দেয়াল দিয়ে ঘেরা অংশে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর, জাতীয় চার নেতা স্মৃতি জাদুঘরসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো ‘কারা জাদুঘর’ হিসেবে রাখা হয়েছে।
অন্যদিকে মহিলা কারাগার এলাকার একপাশে চকবাজারসংলগ্ন এলাকাটিতে উদ্যান ও পুকুরঘেরা খোলা জায়গায় সময় কাটাতে পারবে সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে কারা জাদুঘরের উত্তরে অপ্রয়োজনীয় স্থাপনা অপসারণ করে আধুনিক সিনেপ্লেক্স, জিমনেসিয়াম, সুইমিংপুলসহ অত্যাধুনিক নাগরিক সুবিধাসংবলিত একটি অংশ তৈরি হবে।
স্থপতি দিদারুল ইসলাম ভুঁইয়া বলেন, ‘এর মাধ্যমে একদিকে কারা জাদুঘর আমাদের রাজনৈতিক ও স্থাপত্যশৈলীর ইতিহাস ধরে রাখবে, অন্যদিকে পুরান ঢাকার বর্তমান চাহিদা পূরণে উন্মুক্ত স্থান ও আধুনিক সুবিধা থাকবে।’
যা থাকবে জাতীয় চার নেতা স্মৃতি জাদুঘরে
প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় চার নেতা স্মৃতি জাদুঘর এলাকায় রয়েছে কারাগারের চারটি ভবন। এগুলো নীলনদ, জেলসুপারের বাসভবন, সেল ১৫ ও মৃত্যুঞ্জয়ী সেল নামে পরিচিত। এর মধ্যে সেল ১৫ ছাড়া অন্যগুলো ঔপনিবেশিক আমলে পাগলাগারদ হিসেবে নির্মাণ করা হয়।
মৃত্যুঞ্জয়ী সেলের সামনে এখন চার নেতার আবক্ষ মূর্তিসহ ছোট বাগান ও ঝরনা রয়েছে। তবে নতুন নকশায় এই বাগান ও ঝরনা সরিয়ে ফেলা হবে। চার নেতার আবক্ষ মূর্তি আরও ভালোভাবে দেখার মতো পরিবেশ তৈরি করা হবে। দেখার সুবিধার্থে সেগুলো নতুন করে প্রতিস্থাপন করা হবে।
সেল ১৫ আংশিক ভেঙে ভাস্কর্য প্যাভিলিয়ন ও গ্যালারি হিসেবে পুনর্নির্মাণ করা হবে। কারাগারের ভেতরে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার জাতীয় চার নেতার সম্পর্কে ঐতিহাসিক তথ্যগুলো প্রদর্শনের জন্য রাখা হবে সেখানে।
জেলসুপারের বাসভবনটি জাদুঘরে প্রবেশ ও বের হওয়ার ‘গেটহাউস’ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। আর নীলনদ নামে বিদেশি বন্দি সেলটিকে প্রদর্শন গ্যালারি হিসেবে সংরক্ষণ করা হবে। বঙ্গবন্ধু কারা স্মৃতি জাদুঘর ও জাতীয় চার নেতার স্মৃতি জাদুঘরের মধ্যে একটি হাঁটাপথ তৈরি করা হবে।
নকশা অনুযায়ী পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে আরও নানা স্থাপনা গড়ে উঠবে। এই প্রকল্পের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের যুগ্মসচিব আলী রেজা সিদ্দিকী বলেন, ‘প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনী। এর কাজ চলছে। জাতীয় চার নেতার স্মৃতি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কারা স্থাপনাগুলো পুরোনো চেহারা অবিকৃত রেখে একটি আধুনিক জাদুঘর গড়ে তোলা হচ্ছে। সেখানে অডিও-ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট থাকবে। আলো ও শব্দ ব্যবহার করে আমরা ইতিহাস বলার চেষ্টা করব।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর তার ঘনিষ্ঠ এই চার আওয়ামী লীগ নেতাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। সেখানেই হত্যা করা হয় তাদের।
পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডে ১৮০৬ সালে ২৫ একর জমির ওপর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার নির্মাণ করা হয়। বন্দির তুলনায় ধারণক্ষমতা না থাকায় ও পুরোনো হয়ে যাওয়ায় কেরানীগঞ্জে নতুন কারাগার নির্মাণ করা হয়। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে পুরোনো কারাগার থেকে সব কয়েদিকে নতুন কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। এরপর থেকেই পুরোনো কারাগার ঘিরে নতুন পরিকল্পনা নেয় সরকার। সে অনুযায়ী জাদুঘর ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলছে।