ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে ৩৪৯ সদস্য নিয়ে চলছে ব্যাপক সমালোচনা। আংশিক কমিটির ৪৫ মাস পর দেয়া এ পূর্ণাঙ্গ কমিটি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়েও বড়।
২০১৯ সালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের ৩০১ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির থেকেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কমিটির সদস্যসংখ্যা ৪৮টি বেশি।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য রোববার ছাত্রলীগের ফেসবুক আইডি থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখার এ পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রকাশ করেন। তাদের মধ্যে রোববার রাতে ২৯৫ জন ও সোমবার দুপুরে ৫৪ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়।
শুধু আকারে বড় নয়, এ কমিটিতে উপসম্পাদক পদই দেয়া হয়েছে ১৩৬ জনকে। এ ছাড়া ৯০ জনকে সহসভাপতি এবং সহসম্পাদক করা হয়েছে ৫৯ জনকে।
অভিযোগ উঠেছে, কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছেন বিবাহিত, অছাত্র, মাদকসেবী, প্রবাসী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় এবং বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িতরাও।
জেলা ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা জানান, ২০১৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সম্মেলনের ১০ দিন পর রবিউল হোসেন রুবেলকে সভাপতি ও শাহাদাৎ শোভনকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রলীগের সাত সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এক বছর মেয়াদের সেই কমিটির ৩ বছর ৯ মাস পর দেয়া হলো পূর্ণাঙ্গ এ কমিটি।
দীর্ঘ প্রতীক্ষিত হলেও কমিটি হওয়ার পরই এর আকার ও পদ পাওয়া নেতা-কর্মীদের নিয়ে শুরু হয়েছে সমালোচনা। এ ছাড়া মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে শহরের ভাদুঘর থেকে ছাত্রলীগের পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীরা বিক্ষোভ মিছিলও করেছেন।
স্থানীয় ছাত্রলীগের এক নেতা নিউজবাংলাকে জানান, পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সহসভাপতি পদ পাওয়া আমির হামজা ভূঁইয়া নাহিদের বয়স বেশি। সহসভাপতি মোবারক হোসেন মোবাইল ব্যবসায়ী ও এক কন্যাসন্তানের বাবা।
এ ছাড়া পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে অন্তত অর্ধশতাধিক বিবাহিতকে পদ দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ তার।
সহসভাপতি হওয়া শাফি আলম এবং উপ-ত্রাণ ও দুর্যোগবিষয়ক সম্পাদক জুবায়ের আহমেদ ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে জুবায়েরের একটি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।জেলা ছাত্রলীগের এক শীর্ষ নেতা বলেন, ‘ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে আমি বাকরুদ্ধ। মন চায় পদত্যাগ করি। এত বড় কমিটি দিয়ে কী করব জানি না।’একাধিক নেতা-কর্মী তুলেছেন টাকার বিনিময়ে কমিটি দেয়ার অভিযোগ।
শুধু নেতা-কর্মী নন, সাধারণ মানুষও মেতেছেন আলোচনা-সমালোচনায়। শহরের বিভিন্ন চায়ের স্টলে কমিটির উদ্ভট আকার নিয়ে চলছে বিতর্ক। অধিকাংশেরই মত, এত সদস্যের কমিটি তারা জীবদ্দশায় দেখেননি।
রিকশাচালক হামিদ মিয়া বলেন, ‘আমি বাপ শহরের শেরপুর থাকি। বয়স হইয়া গেছেগা ৬০ বছর। বলতে ডর কিতা। ছাত্রলীগের পুলাপাইন তো সব জায়গায় ভেজাল করে।
‘অহন হুনি ২০০-র উফরে লোক আছে কমিটিত। হগলেই নেই হইব। বালা কইডা নেতা রাইক্কা বাহিডিরে (বাকিগুলোরে) বাদ দেলাইলেই কইলাম হয়।’
এক ফুল বিক্রেতা বলেন, ‘আমি ছাত্রলীগের হগল মিছিলো ছোড ছোড (ছোট ছোট) পুলাপাইন দেহি। তারা কেমনে রাজনীতি করে বুঝি না। বয়স তো অনেক হইসে, অনেকতা বুঝি। কিন্তু ভাই সব কতা কওন যানা অহন দুনিয়াত।’
কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ে বড় কমিটি দেয়ায় সমালোচনায় যোগ দিয়েছে শিক্ষিত সমাজও। তাদের অভিযোগ, যারা ওয়ার্ড কমিটিতে আসার যোগ্য না, তাদেরও জেলা কমিটিতে পদ দেয়া হয়েছে। রাজনীতির পদ এখন অনেকটাই সস্তা হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদাৎ হোসেন শোভন বলেন, ‘কেন্দ্রীয়ভাবে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। কমিটিতে থাকা কারও বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে বিষয়টি কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে অবহিত করে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানানো হবে।’
জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রবিউল হোসেন বলেন, ‘আমরা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কাছে এত বড় কমিটি জমা দিইনি। তবে কমিটিতে পদ পাওয়া ছাত্রলীগ সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের বিষয়ে যদি কেউ সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দেখাতে পারেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীদের বিক্ষোভ
বিশাল আকৃতির কমিটির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন পদবঞ্চিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে শহরের ভাদুঘর থেকে ছাত্রলীগের পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীরা অর্ধশতাধিক মোটরসাইকেল নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিলটি শহরের প্রধান ভাদুঘর, কাউতলী, কলেজপাড়া, কালীবাড়ি মোড়, টিএ রোড ও হাসপাতাল মোড় ঘুরে জেলা প্রেস ক্লাবের সামনে শেষ হয়।
সেখানে সমাবেশে সদ্য ঘোষিত জেলা ছাত্রলীগের কমিটি সংশোধনের জন্য সাত দিনের আল্টিমেটাম দেয়া হয়।
পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীরা জানান, তারা চান জেলা ছাত্রলীগ একটি পরিচ্ছন্ন ও ছাত্র-জনতার কমিটি হোক। যারা রোদে-বৃষ্টিতে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, যারা রাজপথে বিএনপির আগুন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মাঠে ছিল, তাদের এই কমিটিতে মূল্যায়ন করা হয়নি।
ছাত্রলীগের কমিটি সংশোধন করে বিবাহিত, অছাত্র, মাদক ব্যবসায়ীদের সরাতে হবে। আগামী সাত দিনের মধ্যে জেলা ছাত্রলীগের এই কমিটি সংশোধন করা না হলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
তারা অভিযোগ করেন, বিবাহিত, অছাত্র, মাদক ব্যবসায়ী ও মাদক মামলার আসামি প্রায় ১০০ জন এই কমিটিতে পদ পেয়েছেন। তাদের মধ্যে মাদক ব্যবসায়ী ১০-১২ জন, বিবাহিত ২০-২৫ জন, অছাত্র ৮-১০ জন এবং ছাত্রদলের কমিটি থেকে এসেছেন ৫-৭ জন।