টানা দরপতনের মধ্যে থাকা পুঁজিবাজারের সূচক আবার কমল টানা তিন কর্মদিবস।
গত দুই সপ্তাহ মিলিয়ে সাত কর্মদিবস পতনের পর টানা তিন দিনের উত্থান শেষে চলতি সপ্তাহে আবার পুরোনো দৃশ্য বাজারে হতাশা বাড়িয়ে দিয়েছে।
গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া দর সংশোধন গত সপ্তাহে আতঙ্ক তৈরি করে। তবে টানা সাত কর্মদিবস পতন শেষে ২৬ থেকে ২৮ অক্টোবর সূচক বাড়ার পর চলতি সপ্তাহে তিন দিনই আবার পতন হলো।
রোববার ৬২ পয়েন্ট, সোমবার প্রায় ৩ পয়েন্টের পর মঙ্গলবার সূচকের পতন হলো ৪৩ পয়েন্ট। গতি ফিরে পায়নি লেনদেনও।
সূচকের পতনে প্রধান ভূমিকায় ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো। কোম্পানিটি থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ২ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা বকেয়া রাজস্ব দাবি করেছে- এই খবর আগের দিন প্রকাশ হয় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে। এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার পর এই দাবি স্থগিত হয়েছে। তারপরেও বিষয়টি মনস্তাত্ত্বিক চাপে ফেলেছে বিনিয়োগকারীদের।
সূচকের পতনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকায় ছিল এই ১০টি কোম্পানি
এ ছাড়া লাফার্জ হোলসিম সিমেন্ট, ওয়ালটন, স্কয়ার ফার্মা, আইসিবি, ইউনাইটেড পাওয়ার, ওরিয়ন ফার্মা, আইএফআইসি ব্যাংক, ডেল্টা লাইফ, বিকন ফার্মার মতো বড় মূলধনি কোম্পানির দরপতনের চাপ নিতে পারেনি পুঁজিবাজার।
এই ১০টি কোম্পানির দরপতনেই সূচক কমেছে ৩৬.৫৩ পয়েন্ট।
গ্রামীণফোন, ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স, বেক্সিমকো ফার্মা, ম্যারিকো, রিংসাইন টেক্সটাইল, রহিমা ফুড, কেয়া কসমেটিকস, ইবিএল, বিডি ফাইন্যান্স ও ফার কেমিক্যাল সূচকের আরও বড় পতন ঠেকিয়েছে।
এই ১০টি কোম্পানি মিলে সূচক বাড়িয়েছে ১৩.৮১ শতাংশ।
এই ১০টি কোম্পানি সূচকের আরও বেশি পতন ঠেকিয়েছে।
ক্রমেই কমছে শেয়ার দর। এর মধ্যে অবশ্য আলো ছড়াচ্ছে বস্ত্র খাত। লেনদেনের চার ভাগের একভাগই এখন একটি খাতে। সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধি পাওয়া কোম্পানিগুলোর তালিকাতেও এই খাতেরই প্রাধান্য।
সব মিলিয়ে লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ২৯৫ কোটি ১১ লাখ টাকা। এর মধ্যে বস্ত্র খাতের অবদান ৩৩৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
এর মধ্যে শেয়ারে ২০ পয়সা লভ্যাংশ ঘোষণা করা একটি কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে ২২ শতাংশ। একই খাতের আরও তিনটি কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে এক দিনে যত বাড়া সম্ভব ততই।
বিপরীতে ব্যাংক, জ্বালানি, বিমা খাতে ঢালাও পতন হয়েছে। অন্যদিকে প্রকৌশল খাতে দেখা গেছে ভালো দিন। আর্থিক, খাদ্য ও আনুষঙ্গিক, ওষুধ ও রসায়ন, বিবিধ ও সিমেন্ট খাতে দেখা গেছে মিশ্র প্রবণতা।
দিন শেষে সূচকের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৯৫৪ দশমিক ৩৫ পয়েন্ট। দিন শেষে বেড়েছে ১৪৭টির দর, কমেছে ২০১টির। অপরিবর্তিত ছিল বাকি ২৮ টির দর।
মঙ্গলবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের এই চিত্র বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ছড়িয়ে যাওয়া হতাশা আরও বাড়িয়েছে
লেনদেনের সিংহভাগ চার খাতে
গত সপ্তাহ থেকেই হঠাৎ করে বস্ত্র খাতে বিনিয়োগকারীদের ঝোঁক দেখা দেয়। চলতি সপ্তাহে তা আরও বেড়েছে। আগের দিন ২২৫ কোটি টাকা হাতবদল হয়েছিল। তা আরও বেড়ে পরদিন হয়েছে ৩৩৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
এই খাতের ৫৮টি কোম্পানির মধ্যে দাম বেড়েছে ৩৫টির, কমেছে ১৯টির, অপরিবর্তিত ছিল বাকি চারটির দর।
এই খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে প্রাইম টেক্সটাইলের দর। চতুর্থ প্রান্তিকের অবিশ্বাস্য আয়ে লোকসান কাটিয়ে কোম্পানিটি গত ৩০ জুন সমাপ্ত অর্থবছরে ৬২ পয়সা আয় করার পর ২০ পয়সা লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে।
গত বছর শেয়ার প্রতি ২ টাকা ৬৭ পয়সা লোকসান দেয়া কোম্পানিটি এবারও মার্চ পর্যন্ত শেয়ারে ২ টাকা ১২ পয়সা লোকসানে ছিল। সেখান থেকে মুনাফায় ফিরে ২ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণায় বিনিয়োগকারীরা এতটাই আপ্লুত হয়েছে যে, বিনিয়োগকারীরা আগের দিনের চেয়ে ২২.৩১ শতাংশ বেশি দাম দিতে রাজি ছিলেন।
আগের দিন শেয়ারদর ছিল ২৪ টাকা ২০ পয়সা। দিন শেষে দাম দাঁড়িয়েছে ২৯ টাকা ৬০ পয়সা। তবে দিনের সর্বোচ্চ দর ছিল ৩২ টাকা।
গত সপ্তাহ থেকেই বস্ত্র খাতের প্রতি বিনিয়োগাকারীদের ব্যাপক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে
শেয়ারে ২০ পয়সা করে লভ্যাংশ ঘোষণা করার পর দর কমে যাওয়া ইভিন্স টেক্সটাইল ঘুরে দাঁড়িয়ে এক দিনেই দর বেড়েছে ৯.৬৪ শতাংশ।
পর্ষদ পুনর্গঠন করার পর উৎপাদন চালু হওয়া রিংসাইন টেক্সটাইলের দর বেড়েছ ৯.২৫ শতাংশ। এছাড়া ডেল্টা স্পিনার্সের দর ৯.০৯ শতাংশ, রিজেন্ট টেক্সটাইলের দর ৮.৬২ শতাংশ, তাল্লু স্পিনিংয়ের দর ৬.০৩ শতাংশ, মোজাফফর হোসেন স্পিনিং মিলসের দর ৫.৫৩ শতাংশ, আনলিমা ইয়ার্নের দর ৫.৩৩ শতাংশ, তুংহাইয়ের দর ৫.০৮ শতাংশ, ঢাকা ডায়িংয়ের দর ৪.৯১ শতাংশ বেড়েছে।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে ওষুধ প্রযুক্তি খাতে। হাতবদল হয়েছে মোট ১৫৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। দাম বৃদ্ধি ও হ্রাস পাওয়া কোম্পানির সংখ্যা সমান সংখ্যক ১৫টি করে। আগের দিন লেনদেন ছিল ১৪০ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
এই খাতের কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ফার কেমিক্যালের দর, ৯.৪৪ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮.২৫ শতাংশ বেড়েছে সালভো কেমিক্যালের দর। এছাড়া লিবরা ইনফিউশনের দর ৭.৪৯ শতাংশ, ফার্মা এইডের দর ৭.৪৮ শতাংশ, কেয়া কসমেটিকসের দর ৫.১৯ শতাংশ, ওয়াটা কেমিক্যালের দর ৪.৮১ শতাংশ, সেন্ট্রাল ফার্মার দর ৪.৫৪ শতাংশ বেড়েছে।
কোম্পানিগুলো দর হারালেও ব্যাংকিং খাতে লেনদেনের গতি ছিল ভালো। ৩২টি কোম্পানির মধ্যে বেড়েছে কেবল ২টির দর, কমেছে ২৫টির, অপরিবর্তিত ছির বাকি ৫টির।
লেনদেন হয়েছে ১৫০ কোটি ৭৪ লাখ টাকা, যা আগের কর্মদিবসের তুলনায় বেশি। সোমবার এই খাতে লেনদেন হয় ১২৬ কোটি ৬ লাখ টাকা।
কেবল ইবিএলের শেয়ার দর বেড়েছে ৪০ পয়সা আর ব্যাংক এশিয়ার ১০ পয়সা। বিপরীতে ডাচ্-বাংলার শেয়ার সবচেয়ে বেশি ১ টাকা ১০ পয়সা, রূপালী ব্যাংকের শেয়ার এক টাকা, এনআরবিসির শেয়ার ৮০ পয়সা, আইএফআইসি ৬০ পয়সা, শাহজালাল ৫০ পয়সা, সিটি ও মার্কেন্টাইলের শেয়ার ৪০ পয়সা করে দর হারিয়েছে। বাকি ব্যাংকগুলোর শেয়ারদর ১০ থেকে ৩০ পয়সা করে দর হারিয়েছে।
বেক্সিমকো লিমিটেডের কল্যাণে বিবিধি খাত সবচেয়ে বেশি লেনদেন হওয়া খাতের মধ্যে চতুর্থ স্থানে উঠে এসেছে। এই খাতে লেনদেন হয়েছে ১৪২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, যা আগের দিন ছিল ১৪৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। এর মধ্যে বেক্সিমকো লিমিটেডেই হাতবদল হয়েছে ১২৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।
এই খাতের ১৪টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ৮টির, কমেছে ৬টির।
অন্যান্য খাতে লেনদেন
প্রকৌশল খাতে শেয়ারদর বাড়লেও লেনদেনে গতি ফেরেনি। ৪২টি কোম্পানির মধ্যে ২৮টিরই শেয়ারদর বেড়েছে। কমেছে ১৩টির। লেনদেন হয়েছে ৭৫ কোটি ৭ লাখ টাকা। আগের দিন এই খাতে লেনদেন ছিল ৭২ কোটি ১৭ লাখ টাকা।
বিমা খাতে ঢালাও পতন হয়েছে। ৫১টি কোম্পানির মধ্যে দর হারিয়েছে ৪৫টি। বেড়েছে কেবল ৫টির দর, অপরিবর্তিত ছিল একটির দর।
লেনদেন কমে আবার ১০০ কোটি টাকার নিচে নেমেছে। হাতবদল হয়েছে মোট ৭৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন ছিল ১২৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
বিদ্যুৎ-জ্বালানির ২৩টি কোম্পানিতে লেনদেন কমে হয়েছে ৫২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। বেড়েছে কেবল ৬টির দর, কমেছে ১৭টির।
আগের দিন এই খাতে লেনদেন ছিল ৫৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।
এই খাতগুলোর বেশিরভাগেই লেনদেন আগের দিনের চেয়ে পড়ে গেছে
আর্থিক খাতের ২৩টি কোম্পানির মধ্যে একটির লেনদেন স্থগিত। বাকিগুলোর মধ্যে বেড়েছে ১২টির দর, কমেছে ৮টির। দুটির দর ছিল অপরিবর্তিত।
লেনদেন হয়েছে ৪৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আগের দিন এই খাতে লেনদেন ছিল ৫১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।
খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের ২০টি কোম্পানির মধ্যে সমান সংখ্যক ১০টি করে কোম্পানির শেয়ারদর বেড়েছে ও কমেছে। লেনদেন হয়েছে ৫৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আগের দিন এই খাতে লেনদেন ছিল ৪৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা।
সিমেন্ট খাতে ৭টি কোম্পানির মধ্যে ৩টির দর বৃদ্ধির বিপরীতে কমেছে ৪টির দর। লেনদেন আরও কমে হয়েছে ২৯ কোটি ২১ লাখ টাকা। আগের দিন এই খাতে লেনদেন ছিল ৩৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
প্রায় সব খাতেই লেনদেন কমার দিন ঘুমিয়ে থাকা মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতে লেনদেন কিছুটা বেড়েছে। আগের দিন হাতবদল হয়েছিল ১২ কোটি ২০ লাখ টাকা। সেটি খানিকটা বেড়ে হয়েছে ১৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
তবে দরপতনের বৃত্ত থেকে বের হতে পারেনি খাতটি। চারটি ফান্ডের দর বেড়েছে ১০ পয়সা করে। কমেছে ২৪টির দর। অপরিবর্তিত ছিল বাকি ৮টি।