তিন দিন নিখোঁজ থাকার পর গত বছরের ১ নভেম্বর আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার চট্টগ্রাম ব্যুরো অফিসের নিজস্ব প্রতিবেদক গোলাম সারওয়ারকে প্রায় অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
সীতাকুণ্ডের একটি সেতুর নিচ থেকে উদ্ধার হওয়া সারওয়ার অসংলগ্নভাবে বলছিলেন, ‘আমারে মাইরেন না, আমি আর নিউজ করব না।’
পরে অজ্ঞাতনামা ছয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা করেন সারওয়ার। গত সেপ্টেম্বরে সে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। তবে সারোয়ার অপহৃত হয়েছিলেন, এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ তদন্তে পাওয়া যায়নি। আদালত এই প্রতিবেদন আমলে না নিয়ে অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইকে দায়িত্ব দিয়েছে।
পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়ায় সারোয়ার বলেন, ‘আমাকে কি তাহলে কেউ অপহরণ করেনি?’
সারওয়ারের নিখোঁজের নেপথ্যের ঘটনা নিয়ে করা এক প্রতিবেদনে ক্ষুব্ধ হয়ে চট্টগ্রামের আদালতে সারওয়ারসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকার মানহানির মামলা করেন এক মন্ত্রীর ভাই। এমনকি সারোয়ারের সাংবাদিকতার সনদ যেন বাতিল করা হয়, সে বিষয়েও চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করা হয়।
এর আগেও সংবাদ প্রকাশের জেরে নির্যাতনের শিকার বহু সাংবাদিক বিচার পাননি। ভার্চুয়াল মাধ্যম নিরাপদ করার জন্য করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকদের হয়রানির নতুন ও সবচেয়ে আধুনিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার (২ নভেম্বর) জাতিসংঘ পালন করছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের দায়মুক্তি অবসান দিবস।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন আর্টিকেল-১৯-এর তথ্য বলছে, ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ৪১টি মামলা হয়েছে। অনলাইনে খবর প্রকাশ ও শেয়ার বা মত প্রকাশের কারণে এসব মামলা হয়। এতে অভিযুক্ত ছিলেন ৭৫ জন, যার মধ্যে ৩২ জনকে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে। আর চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৫ মামলায় ৪৮ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়। এর মধ্যে ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আর্টিকেল-১৯ বলছে, এ আইনটি সাধারণ মানুষের চেয়ে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেই তুলনামূলকভাবে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০২০ সালে মোট ১৯৭টি মামলার মধ্যে ৪১টিই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ প্রতি পাঁচটি মামলার একটি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে করা। এসব মামলায় ৩৬৮ জনের মধ্যে ৭৫ জন সাংবাদিক। চলতি বছরেও এখন পর্যন্ত ৩৫৩ অভিযুক্তের মধ্যে সাংবাদিক ৪৮ জন। ১৮৮টি মামলার মধ্যে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ২৫টি।
গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ এবং সাংবাদিকদের জাতির বিবেক বলা হয়। গণমাধ্যম স্বাধীন হলেই তার সুফল সরকার তথা জনগণ পায়। আশঙ্কার বিষয়, সাংবাদিক হত্যাকাণ্ড বা তাদের ওপর হামলার বেশির ভাগেরই বিচার হয় না।
সাংবাদিকদের নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)-এর তথ্য বলছে, ২০০০ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ২৯ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটনার কোনো বিচার হয়নি। আবার ২০২০ সালেই ছয় সাংবাদিক কারাবরণ করেছেন।
গত ২৮ অক্টোবর প্রকাশিত সিপিজের সাংবাদিক হত্যার ক্ষেত্রে বিচার না হওয়া নিয়ে বিশ্ব দায়মুক্তি সূচকে (গ্লোবাল ইমপিউনিটি ইনডেক্স) বাংলাদেশের অবস্থান ১২ দেশের মধ্যে ১১তম। বাংলাদেশের সামনে রয়েছে রাশিয়া, পাকিস্তান, ব্রাজিল, ফিলিপাইন, মেক্সিকো, আফগানিস্তান, দক্ষিণ সুদান, ইরাক, সিরিয়া ও সোমালিয়া। আর বাংলাদেশের পরই রয়েছে ভারতের অবস্থান। সিপিজের তথ্য বলছে, গত ২০ বছরে বিশ্বে ১ হাজার ৫৬২ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।
সিপিজে বলছে, দুর্নীতি, দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং তদন্তে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবের কারণে সাংবাদিক হত্যার বিচার হয় না এবং হত্যাকারীরা দায়মুক্তি পায়। এ ছাড়া আইনি বাধাও সাংবাদিক হত্যার বিচারে ভূমিকা রাখে বলে সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়।
ঐক্যের অভাব
সাংবাদিকদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভক্তিও নির্যাতনের কারণ মনে করছেন অনেকে। প্রতিটি সাংবাদিক সংগঠনই রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত। অধিকারের প্রশ্ন এলেই রাজনৈতিক বিভক্তি বড় করে চোখে পড়ে।
দেশের সাংবাদিক নিপীড়নের কারণ হিসেবে সাংবাদিকদের মধ্যে আন্তরিকতা ও ঐক্যের অভাবকে দায়ী করছেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) একাংশের নবনির্বাচিত সভাপতি ওমর ফারুক।
ওমর ফারুক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বড় সমস্যা হচ্ছে আমাদের মধ্যে ঐক্যের অভাব, আন্তরিকতার অভাব। আমরা যদি রাজপথে বা যেকোনো জায়গায় ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের ভয়েস তুলতে পারতাম, কথা বলতে পারতাম, তাহলে বিচার পেতাম। অন্যরা আমাদের সমীহ করত। অন্তত আমাদের সঙ্গে অন্যায় করার সাহস পেত না।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘প্রেস ক্লাব ও ডিআরইউতে বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ সব দলের সমর্থক সাংবাদিক একসঙ্গে চলাফেরা করে, উঠে-বসে, তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু অধিকারের প্রশ্ন এলেই এক দল এক দিকে চলে যায়, এক থাকে না।’
চলতি বছরের সাংবাদিক হত্যা
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বিকেলে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চাপরাশির হাট এলাকায় সেতুমন্ত্রীর ছোট ভাই আবদুল কাদের মির্জা এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বাদল গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার সংবাদ সংগ্রহের সময় দৈনিক বাংলাদেশ সমাচার পত্রিকার কোম্পানীগঞ্জ প্রতিনিধি বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির গুলিবিদ্ধ হন। পরে তিনি হাসপাতালে মারা যান।
মুজাক্কিরের বাবার করা মামলায় জামিন পান অন্যতম আসামি আব্দুল মালেক, যদিও পরে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ জামিন বাতিল করে।
সাগর-রুনি হত্যা
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারোয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনিকে হত্যা করা হয়। এরপর নিহত রুনির ভাই নওশের আলম রোমান শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। এ নিয়ে ৮২ বার পেছানো হয়েছে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার তারিখ। আগামী ২৪ নভেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার দিন ধার্য করেছে আদালত।
১০ বছরেও মামলার কোনো সুরাহা হয়নি।
সাংবাদিকদের জন্য আলাদা আইন কত দূর
সাংবাদিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে ‘গণমাধ্যমকর্মী আইন’ নামে একটি আইন করতে যাচ্ছে সরকার। তবে এটির খসড়া প্রণয়ন এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
সাংবাদিকদের জন্য আলাদা আইন সম্পর্কে ওমর ফারুক বলেন, ‘এ আইন নিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে কথা হয়েছিল, কিন্তু লিখিত কোনো ভিত্তি তৈরি হয়নি। এর খসড়া তৈরি করে সরকারের কাছে জমা দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু আমরা তা পারি নাই। বিএফইউজের নতুন কমিটি এটা নিয়ে সরকারের সঙ্গে কাজ করবে। দ্রুত যাতে এ আইন করা যায় তা দেখা হবে।’