দেনার দায়ে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়া পুঁজিবাজারের বস্ত্র খাতের তালিকাভুক্ত মিথুন নিটিং অ্যান্ড ডায়িং লিমিটেডের যন্ত্রপাতিসহ পুরো কারখানা নিলামে বিক্রি করে দিয়েছে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা)।
তবে এই মূল্য সংবেদনশীল তথ্যের কোনো ঘোষণা দেয়া হয়নি পুঁজিবাজারে। আর সম্প্রতি কোম্পানিটির শেয়ার দর অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গিয়ে পরে আবার কমেছে। এই প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগকারীরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (সিইপিজেড) মহাব্যবস্থাপক মফিজউদ্দিন বিন মেজবা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নিলাম হয়ে গেছে। একটি রেটে (দামে) আমরা যন্ত্রপাতিসহ কারখানাটি বিক্রি করেছি। তবে সেই রেটটি বলা যাচ্ছে না। নিলামের প্রস্তাবটি বেপজার নির্বাহী বিভাগে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। অনুমোদন পেলে আমরা যন্ত্রপাতিসহ পুরো কারখানা ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে হস্তান্তর করব।’
মিথুন নিটিংয়ের কাছে কত টাকা পাবে বেপজা এবং নিলাম কখন হয়েছে, এসব বিষয় জানতে চাইলে মফিজউদ্দিন বলেন, ‘কত টাকা পাব, সেই বিষয়টি আমরা বলতে চাচ্ছি না। আর দুই মাস আগে নিলাম হয়েছে। এখন হস্তান্তর প্রক্রিয়ার জন্য অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।’
কোম্পানি বিক্রি হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা পুঁজিবাজারকে আনুষ্ঠানিকভাবে কেন জানানো হলো না, তা জানতে মিথুন নিটিংয়ের পরিচালক মাহাবুবুল হকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। ই-মেইল করা হলেও তিনি জবাব দেননি।
মিথুন নিটিং যে মালিকের কারখানা, একই গ্রুপের আরেক কোম্পানি তাল্লু স্পিনিংয়ের বিরুদ্ধেও সম্প্রতি মূল্য সংবেদনশীল তথ্য গোপনের ঘটনা ঘটেছে। গত বছর করোনার সময় কারখানা বন্ধ রাখার তথ্য প্রকাশের দেড় বছর পর তারা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, ১৫ মাস আগে তাদের কারখানা চালু হয়েছে। কোম্পানিটির শেয়ার দরও কারখানা বন্ধের পর তলানিতে নেমে আসে। ২ টাকা ৭০ পয়সা থেকে শেয়ারদর সম্প্রতি বেড়ে ১৬ টাকা ৫০ পয়সা হয়ে যায়। তবে এরপর দাম কমে ১১ টাকা হয়ে গেছে।
সিইপিজেড ৪ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত মিথুন নিটিংয়ের কারখানা। ২০১৭ সাল থেকে লোকসানে থাকা কোম্পানিটির কাছে বেপজাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাওনা প্রায় ২০ কোটি টাকা।
বিদেশি ক্রেতাদের সংগঠন অ্যাকর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী সংস্কার করতে না পারায় কোম্পানিটিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। ফলে বিদেশি ক্রেতারা ক্রয়াদেশ বন্ধ করে দেয়।
এরপর গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল এবং প্লটের লিজ বাবদ বকেয়া কয়েক কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ায় ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বেপজা মিথুন নিটিংয়ের সব ধরনের সেবা সংযোগ বন্ধ করে দেয়। ফলে কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয় মালিকপক্ষ।
একই বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর ডিএসই ও সিএসইতে নোটিশ দিয়ে মিথুন নিটিং তাদের উৎপাদন বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়। কিন্তু এরপর কারখানা বিক্রি করে দেয়ার বিষয়ে আর কোনো তথ্য জানানো হয়নি।
বেপজা কর্মকর্তারা জানান, কোম্পানিটির যন্ত্রপাতি ছাড়াও স্থাপনা, মজুত পণ্যসহ সব ধরনের স্থায়ী ও অস্থায়ী সম্পত্তি বিক্রি করে দেয়া হয়েছে।
১৯৯৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় মিথুন নিটিং। ৮০ কোটি টাকা অনুমোদিত মূলধনধারী কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ৩২ কোটি ৪৯ লাখ ১০ হাজার টাকা। ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে থাকা এই কোম্পানি সর্বশেষ ২০১৬ সালে ২০ শতাংশ বোনাস দেয়। এরপর আর লভ্যাংশ দিতে পারেনি।
বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কোম্পানিটির শেয়ারদর ক্রমাগত কমতে কমতে ২০২০ সালের ১৮ মার্চ ৫ টাকা ৯০ পয়সায় নেমে আসে। চলতি বছরের ৮ এপ্রিল দাম ছিল ৭ টাকা ৬০ পয়সা। এরপর থেকে অকারণে দাম বাড়তে থাকে। গত ৩ সেপ্টেম্বর একপর্যায়ে দাঁড়ায় ২৬ টাকা ৩০ পয়সায়।
এরপর থেকে আবার কমতে থাকে দাম। গত ২১ অক্টোবর দাম কমে ১৪ টাকা ২০ পয়সায় নেমে আসে। চার কর্মদিবস পর দাম বেড়ে হয় ১৬ টাকা ৩০ পয়সা।
মিথুন নিটিং অ্যান্ড ডায়িংয়ের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৬ সালে ৬ কোটি ৯৯ লাখ ২০ হাজার টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করেছিল কোম্পানিটি।
পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে ৫ কোটি ৯৭ লাখ ২০ হাজার টাকা লোকসান করে কোম্পানিটি। ২০১৮ সালে লোকসান আরও বেড়ে হয় ৭ কোটি ২৭ লাখ ২০ হাজার টাকা।
সবশেষ ২০১৯ সালের মার্চে তৃতীয় প্রান্তিকের যে অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়, তাতে কোম্পানিটির লোকসান দেখানো হয় ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এরপর আর কোনো আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশই করা হয়নি।