কুমিল্লার বাসিন্দা বালু উত্তোলন শ্রমিক সুমন। দীর্ঘদিন কঠোর পরিশ্রমের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। শুক্রবার কর্মরত অবস্থায় হঠাৎ মস্তিষ্কের বাম পাশে রক্ত জমাট বাঁধে ৩১ বছর বয়সী সুমনের। একপাশের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আরেক পাশ দুর্বল হয়ে পড়ে।
প্রথমে কুমিল্লা হাসপাতালে নেয়া হয় সুমনকে। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এ হাসপাতালের নিউরো সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সুমন রানা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এত দিন সবার ধারণা ছিল স্ট্রোক (মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ) শুধু বয়স্ক ব্যক্তিদের হয়। তবে সেই ধারণা এখন পরিবর্তন হয়েছে। করোনার মধ্যে তরুণদের স্ট্রোকের সংখ্যা বেড়েছে। একই সঙ্গে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুও বেড়েছে। মাসে কিংবা বছরে কত সংখ্যক তরুণ রোগী এই হাসপাতালে সেবা নিতে আসেন, সেই পরিসংখ্যান নেই তাদের কাছে। তবে আগের তুলনায় কম বয়সীদের সেবা নেয়ার হার অনেক বেড়েছে বলে জানান এই চিকিৎসক।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যেও এই প্রমাণ মিলেছে। দেশে অসংক্রামক রোগের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এক বছরে স্ট্রোকে মৃত্যু বেড়েছে ৪০ হাজার। দেশে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ২০১৯ সালে মারা গিয়েছিলেন ৪৫ হাজার ৫০২ জন। ২০২০ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫ হাজার ৩৬০ জনে। সচেতনতার ঘাটতি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য সেবনের প্রবণতা, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনসহ নানা কারণে স্ট্রোকের মৃত্যুও বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রা, ফাস্ট ফুড ও মাদক গ্রহণের ফলে যুবকদের বড় একটি অংশ ডায়াবেটিসে ভুগছেন। অনেক কম বয়সে চাপ নিচ্ছেন। এতে করে মানসিক প্রভাব পড়ছে। যেসব তরুণ সেবা নিতে আসেন, তাদের অধিকাংশই আসেন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে।
গত সেপ্টেম্বরে আমেরিকান নিউরোলজি একাডেমির প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়, করোনায় আক্রান্ত তরুণদের মাঝে স্ট্রোকের হার আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনার ফলে স্ট্রোকে আক্রান্ত তরুণদের ৫০ ভাগ রোগীর স্ট্রোকের লক্ষণ প্রকাশিত হওয়ার সময় জ্বর-কাশি শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি উপসর্গ ছিল না। এ ছাড়া তরুণদের ক্ষেত্রে স্ট্রোক করোনার প্রথম লক্ষণ হিসেবে বিবেচনায় আসছে।
৯০ ভাগ স্ট্রোক প্রতিরোধ করা সম্ভব
স্ট্রোক বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, করোনায় আক্রান্ত উপসর্গহীন তরুণদের অর্ধেকই ব্রেইন স্ট্রোকে ভুগতে পারেন। ৩০ বছর বয়স্ক মৃদু করোনায় উপসর্গসহ রোগীরা স্ট্রোক নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, স্ট্রোক মৃত্যুর দ্বিতীয় ও অক্ষমতার তৃতীয় কারণ।
নিম্ন ও মধ্যম আয়ের ৭০ ভাগ দেশেই স্ট্রোকের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। এসব দেশে ৮৭ ভাগ ক্ষেত্রে মৃত্যু ও অক্ষমতার প্রধান কারণ এই রোগ। বিশ্বে প্রতিবছর দেড় কোটি মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়, যাদের ৩০ ভাগই মারা যায়। আর প্রায় ৬০ ভাগ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়।
৯০ শতাংশ স্ট্রোক প্রতিরোধ করা সম্ভব স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মমাফিক জীবন যাপন করলে। আশার কথা হলো, দ্রুত চিহ্নিত করতে পারলে ৭০ শতাংশের বেশি রোগী এর মারাত্মক ছোবল থেকে রেহাই পেতে পারে। এখন পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ৮ কোটি মানুষ স্ট্রোক থেকে সুস্থ হয়েছে।
বাংলাদেশেও বাড়ছে স্ট্রোকের রোগীর সংখ্যা। ঢাকা মেডিক্যালের নিউরো সায়েন্স বিভাগের করা গবেষণা বলছে, দেশে ৪০ বছরে রোগটির তীব্রতা বেড়েছে শতভাগ। বর্তমানে প্রতি চারজনে একজন স্ট্রোকের ঝুঁকিতে রয়েছেন। উল্টোদিকে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে স্ট্রোকের মাত্রা কমেছে ৪২ শতাংশ। ২০৫০ সালে বিশ্বে স্ট্রোকের মোট রোগীর ৮০ শতাংশই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শফিকুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের মধ্যে ৪৮ শতাংশই স্ট্রোকের ঝুঁকিতে রয়েছেন। অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের কারণে প্রতি ১০০ জনে ৩৬ জন স্ট্রোকের শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়া রোগটিতে আক্রান্ত ১৯ শতাংশের দেহে অতিরিক্ত মেদ, ১৭ শতাংশ মানসিক চাপে ভোগেন। এ ছাড়া ২৩ শতাংশ জাঙ্ক ফুডে আসক্ত।’
তিনি বলেন, স্ট্রোকে আক্রান্তের প্রধান কারণ উচ্চ রক্তচাপ। এই কারণে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ করে অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ থাকলে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। এ জন্য প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে।
স্ট্রোকের লক্ষণ
ডা. শফিকুল ইসলাম বলেন, স্ট্রোক দুই ধরনের। রক্তনালি বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং রক্তনালি ফেটে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। স্ট্রোকের লক্ষণগুলো হলো শরীরের ভারসাম্য রাখতে সমস্যা হওয়া, কথা জড়িয়ে যাওয়া, হঠাৎ করে চোখে কম দেখা, মাথা ঘোরানো, অচেতন হয়ে পড়া, শরীরের এক দিক অবশ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
স্ট্রোকে আক্রান্ত ৫০ শতাংশ রোগীর পক্ষাঘাত ঘটে
নিউরো সায়েন্স বিভাগের এই সহযোগী অধ্যাপক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য উল্লেখ করে বলেন, বিশ্বে বছরে দেড় কোটি মানুষ স্ট্রোকজনিত সমস্যায় ভোগে। এর মধ্যে স্ট্রোকে মৃত্যু হয় প্রায় ৫০ লাখের। বাকিদের স্ট্রোকের কারণে পক্ষাঘাতজনিত সমস্যা বরণ করে নিতে হয়। এই রোগীরা পরিবারের বোঝা হয়ে যান। চল্লিশোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। তবে শিশুদেরও স্ট্রোক হতে পারে।