আর দশটা শিশুর মতো দুই হাত নিয়ে জন্ম হয়নি মিরাজের। হাত না থাকায় জন্মের পর থেকেই সম্মুখীন হতে হয়েছে নানা রকম অবহেলার। তবে সবার সব অবহেলাকে পাশ কাটিয়ে মিরাজ সামনে এগিয়ে গেছেন।
পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের যাত্রাপুর গ্রামের মিরাজুল ইসলাম পড়ছেন পাবনা শহীদ বুলবুল সরকারি কলেজের বাণিজ্য বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে। ২০১৯ সালে জিপিএ ৪ দশমিক ৫৬ পেয়ে এসএসসি পাস করেছেন আটঘরিয়া উপজেলার একদন্ত উচ্চ বিদ্যালয় থেকে।
তোরাব আলী ও সূর্য্য খাতুন দম্পতির ছোট ছেলে মিরাজ পড়ালেখার জন্য থাকছেন পাবনা শহরের একটি মেসে। কারও কোনো সাহায্য ছাড়াই নিজের সব কাজ করেন।
পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি ইউটিউবিং করেন। তার ইউটিউব চ্যানেলে কোনো কোনো ভিডিওতে দেখা যায় তিনি অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, কোনো ভিডিও তার দৈনন্দিন জীবনযাপন নিয়ে, কোনোটা নিছক হাস্যরসাত্মক। এখন তার চ্যানেলে প্রায় ২৬ হাজার ফলোয়ার।
ভিডিও বানিয়ে নিজেই এডিট করে আপলোড করেন তার ইউটিউব চ্যানেল মিরাজ আফ্রিদিতে। ফুটবলও ভালো খেলেন তিনি।
মা সূর্য্য খাতুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মিরাজুল জন্মের পরে সবাই বলল ওই ছেলে মানুষ করতে পারবেন না। তখন আমি চিন্তায় পড়ে গেছিলাম। দিনের পর দিন কান্নাকাটি করতে করতে একসময় সাহস করলাম। আল্লাহ যা দিছে তাতেই আমি খুশি।’
মিরাজকে স্কুলে নিয়ে গেলে তারা প্রথমে ভর্তি নেয়নি। মাদ্রাসা থেকেও তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।
সূর্য্য খাতুন বলেন, ‘সব জায়গা থেকে ফিরে এসে পা দিয়েই লেখা শিখল ছেলেটা। এরপর ভর্তি হয়ে বার্ষিক পরীক্ষায় এক রোল করল। তারপর আর কোথাও বাধা পায়নি। লেখাপড়া করে এতদূর এসেছে।
‘বড় হতে হতে সব কাজই নিজে করা শিখছে। এখন আর কারও সাহায্য লাগে না। না খাওয়াদাওয়াতে, না অন্য কোনো কাজে।’
অর্থ দিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন মিরাজ
‘আমরা ভাবছিলাম মিরাজ সবার বোঝা হয়ে থাকবে। তবে সে কারও বোঝা হয়নি। বরং বাবা-মায়ের দায়িত্বও নিয়েছে’, বলেন মিরাজের মা।
বাবা তোরাব আলী বলেন, ‘আমাদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। মিরাজ সবার ছোট। হাত নেই বলে গ্রামের অনেকেই তার জন্ম বৃথা বলে উপহাস করেছিল। ছোটবেলায় যখন ওকে নিয়ে বের হতাম, কোথাও যেতাম, অধিকাংশ মানুষই এ ধরনের কথা বলত। খুব খারাপ লাগত শুনে।
‘প্রবল ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে মিরাজ পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। সবার মন্তব্যকে ভুল প্রমাণ করেছে।’
নিউজবাংলার কথা হয় মিরাজের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার বোন আমাকে ভর্তি করার জন্য স্কুলে নিয়ে গেছিল। স্যার আমাকে দেখে বলেছিলেন, আমি তো লিখতে পারব না। লেখাপড়া করে কী করব? সে জন্য আমাকে তারা ভর্তি নেননি।
‘ওইদিন খুব মন খারাপ হয়। জেদ চেপে যায় যে কেন আমি লিখতে পারব না। আমি লিখবই। লেখার অনেক চেষ্টা শুরু করি কিন্তু পারি না। আমার বোন বাঁশের কঞ্চি ছোট করে কেটে পায়ে ধরিয়ে দিত। আমি তার লেখার ওপর পা ঘোরাতাম। এভাবে একসময় লেখা শিখে যাই।’
মিরাজ জানান, যখন আবারও স্কুলে গিয়ে তার লিখতে পারার কথা জানিয়েছিলেন ওই শিক্ষক প্রথমে বিশ্বাসই করেননি। লিখে দেখানোর পর অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। ভর্তি করে নেন তাকে।
ছোটবেলার স্মৃতি মনে করে মিরাজ বলেন, “আমি স্কুলে যাওয়ার সময় একজন বলেছিল, আমার জন্ম হওয়ার চেয়ে না হওয়া ভালো ছিল। ওই লোকের কথা এখনও আমার কানে বাজে। ওইদিন শপথ করেছিলাম, জীবনে এমন কিছু করব যে তিনিই এসে আমাকে একদিন বলবেন ‘মিরাজ তুমি এখন সমাজের না, তোমার বোঝাই আমরা।’”
ইউটিউব এখন মিরাজের উপার্জনের উৎস হয়ে উঠেছে। সেই অর্থ দিয়ে সমাজের বিভিন্ন অসহায় মানুষকে নানাভাবে সহায়তা করেন তিনি। তাদের ভিডিও করে তার ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করেন।
তিনি বলেন, ‘আমি সহায়তার ভিডিও করি যেন মানুষ আমাকে দেখে শেখে যে আমার মতো যার দুই হাত নাই, সেও আরেকজনের পাশে দাঁড়াতে পারে। আমি মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই। এটাই আমার স্বপ্ন।’
ফুটবল খেলার প্রতি ঝোঁকের বিষয়ে মিরাজ বলেন, ‘যখন ছোট ছিলাম তখন সবার ফুটবল খেলা দেখে আমার খুব খারাপ লাগত। স্যারের কথায় আমিও খেলা শুরু করি। ছয় মাস আগে ঢাকার উত্তরাতে একটা ক্লাবে জয়েন করেছি। সেখানে খেলছি এখন।’