বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

চার বন্ধুর শেষ শয্যাও পাশাপাশি

  •    
  • ৩১ অক্টোবর, ২০২১ ১৭:৪৩

স্থানীয় হানিফ উদ্দিন বলেন, ‘ওই শিশুদের বাড়ির পাশেই আমার বাড়ি। প্রতিদিন সকালে কাজে যাওয়ার জন্য বের হলেই তাদের দেখি খেলাধুলা করতে বাড়ির পাশের উঠানে। কী চমৎকার করে তারা চাচ্চু বলে ডাকত। ভাবতেই খুব কষ্ট পাচ্ছি। শিশুগুলো আমার প্রতিবেশী হলেও অনেক আপন মনে হতো।’

নওগাঁ শহরের আরজি নওগাঁ গ্রামের নিত্যদিনের ব্যস্ততা দেখা যায়নি রোববার সকালে। চারদিকে শোক; চাপা কান্নায় সন্তানকে বুকে চেপে আছেন বাবা-মায়েরা।

এই গ্রামের চার শিশু শনিবার দুপুরে খেলতে গিয়ে পুকুরে ডুবে প্রাণ হারিয়েছে। ওই চার শিশু ছিল খেলার সাথি। এর মধ্যে দুইজন ভাই-বোন।

এই শিশুদের চঞ্চলতায় মুখর থাকত এলাকা। খেলতে খেলতেই চার বন্ধু একসঙ্গে পাড়ি দিয়েছে পরপারে। তাদের সমাধিও হয়েছে পাশাপাশি।

মারা যাওয়া শিশুরা হলো টুকু মণ্ডলের ৮ বছরের ছেলে ফরহাদ হোসেন ও ৯ বছরের মেয়ে সুরাইয়া খাতুন, আনোয়ার হোসেনের ১০ বছরের মেয়ে আশা খাতুন এবং আব্দুস সালামের ৮ বছরের মেয়ে খাদিজা খাতুন।

সন্তানহারা পরিবারগুলোতে চলছে মাতম। তাদের সান্ত্বনা দিতে দেখা গেছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের।

স্থানীয়রা বলছেন, একসঙ্গে চার শিশুর মৃত্যুর এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি এ গ্রামে। অভিভাবকরা সাবধান হলে এমন ঘটনা ঘটত না বলে তারা মনে করেন।

স্থানীয় হানিফ উদ্দিন কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, ‘ওই শিশুদের বাড়ির পাশেই আমার বাড়ি। প্রতিদিন সকালে কাজে যাওয়ার জন্য বের হলেই তাদের দেখি খেলাধুলা করতে বাড়ির পাশের উঠানে। কী চমৎকার করে তারা চাচ্চু বলে ডাকত। আর ডাকবে না আমাকে চাচ্চু বলে।

‘ভাবতেই খুব কষ্ট পাচ্ছি। শিশুগুলো আমার প্রতিবেশী হলেও অনেক আপন মনে হতো। আমারই তো খুব কষ্ট লাগছে, তাহলে ভাবুন নিহত শিশুদের মা-বাবারা কত কষ্ট পাচ্ছেন।’

শিশুদের পুকুর থেকে উদ্ধারের সময় সেখানে ছিলেন রাব্বি চৌধুরী।

তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি যখন ঘটে তখন পুকুর থেকে শিশুদের উদ্ধার করার জন্য আমিও ছিলাম, কিন্তু ততক্ষণে খুব দেরি হয়ে গেছে। শিশুদের তোলার পর স্থানীয় এক ডাক্তার এসে তাদের মৃত বলে জানান।

‘একসঙ্গে চার শিশু মারা গেল। এটা মেনে নিতে আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে। বারবার একই কথা ভাবছি, যদি শিশুদের সে সময় বাইরে বের হতে না দিত, যদি তাদের পুকুরপাড়ে যেতে না দিত পরিবারের সদস্যরা, তাহলে আজ এমন দৃশ্য আমাদের কারও দেখতে হতো না। প্রতিবেশীদের সন্তান হলেও তারা আমাদের সন্তানের মতোই ছিল।’

ওই পুকুরের পাশেই বাড়ি জামাল হোসেনের। তিনি বলেন, ‘দুই শিশুকে পুকুরপাড়ে কাঁদতে দেখে আমরা কয়েকজন কাছে যাই। তখন তারা বলে পুকুরে তাদের চার বন্ধু ডুবে গেছে। এরপর আমরা একজনকে পাঠাই তাদের পরিবারকে খবর দিতে। অন্যদিকে আমরা কয়েকজন পুকুরে নেমে শিশুদের উদ্ধার করি।

‘রাতেই শিশুদের দাফন করা হয়েছে। এমন অকাল মৃত্যু শুধু আমাকে নয়, এই এলাকার সবাইকে কাঁদাচ্ছে। যাদের সন্তানরা পরপারে চলে গেল তারা আরও গভীরভাবে আঘাত পেয়েছেন। আহারে এমন করে কারও বুক যেন খালি না হয়। ছোট সন্তানদের প্রতি আমরা যারা অভিভাবক আছি, তাদের আরও দায়িত্ববান হতে হবে।’

স্থানীয় একটি গোরস্থানে পাশাপাশি দাফন করা হয়েছে চার বন্ধুকে।

একসঙ্গে দুই সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় ফরহাদ ও সুমাইয়ার বাবা টুকু মণ্ডল।

তিনি বলেন, ‘হামি (আমি) ফেরি করে ফল বিক্রি করা সংসার চালাই। ছেলে আর মেয়েডা আরজি নওগাঁ সরকারি প্রাথমিক স্কুলে তৃতীয় কেলাশে (ক্লাশে) পড়ত। ইচ্ছা আসলো পড়াশোনা করা দুই জনাক মাস্টার বানামু। হামি মূর্খ মানুষ পড়াশোনা করবার পারিনি। তারা মানুষের মতো মানুষ হবে, কিন্তু হামাকো (আমাকে) ছাড়া আজ চলা গেল ওই পাড়ে।’

মৃত শিশু আশার বাবা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘অটো চালায় পরিবার চালাই। কেলাশ থিরিতে (তৃতীয় শ্রেণিতে) পড়ত হামার মেয়েডা। একমাত্র মেয়েডা মরা গেল আজ। থাক ডাক্তার করবার চাছনু (ডাক্তার বানাতে চেয়েছিলাম)। সেডা আর হলো না। কপাল হামাকে খারাপ। যদি হামরা এ্যানা সচেতন হনুনি তয় আজ এদিন দেকা লাগলোনানি (আমরা সচেতন হলে এই দিন দেখা লাগত না)। কী আর কমু কিছু কওয়ার ভাষা নাই।’

তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত খাতিজা খাতুনও। মেয়েকে হারিয়ে আব্দুস সালাম বলেন, ‘তারা চারজন একসঙ্গেই খেলাধুলা করত-পড়ত। আজ হামার মেয়েডাসহ চারজনার একসঙ্গে কবর দিনু। কলজাডা হামার ফাটা যাচ্ছে কী কমুরে বা (কলিজাটা ফেটে যাচ্ছে কী আর বলব)।’

নওগাঁ সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বলেন, মৃত শিশুদের পরিবারকে সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

নওগাঁ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলাম জুয়েল জানান, মৃত শিশুদের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ না থাকায় এ ঘটনায় থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।

শিশুদের বিষয়ে আরও সচেতন হতে অভিভাবকদের পরামর্শ দিয়েছেন ওসি।

এ বিভাগের আরো খবর