বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

লক্কড়ঝক্কড় ফেরিতেই ঝুঁকি নিয়ে পদ্মা পারাপার

  •    
  • ৩১ অক্টোবর, ২০২১ ০৮:১৬

বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, শতবর্ষের পুরোনো ডাম্ব ফেরিগুলো এখন খুব একটা চালানো হয় না। যখন ঘাটে চাপ বেশি থাকে, তখন চালানো হয়। আগামী বছর আরও পাঁচটি নতুন ফেরি দেশে আনা হবে। তখন এসব ডাম্ব ফেরি বন্ধ করার সুপারিশ করা যাবে। আপাতত এসব দিয়েই চলতে হবে।

শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথে শত বছরের পুরোনো ফেরি দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সড়ক যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। ডাম্ব ফেরি হিসেবে পরিচিত জোড়াতালি দেয়া ফেরিগুলোর সবই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে বহু বছর আগে।

হালকা-মাঝারি ফেরির মেয়াদ থাকলেও পদ্মা নদীতে ড্রেজিং করায় মাঝে মাঝেই দুর্ঘটনাকবলিত হচ্ছে। তবু কোনো রকম ভাঙাচোরা ফিটনেসবিহীন ফেরি জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা নদী পারাপার করছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিসি)।

বেশি নিরাপদ ভেবে যানবাহনের পাশাপাশি যাত্রীরাও ফেরিতে নদী পার হয়।

গত ২৭ অক্টোবর মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাটে শাহ আমানত ফেরি উল্টে যাওয়ার ঘটনাকে বড় ধরনের অশনি সংকেত মনে করছেন যাতায়াতকারীরা। তবে বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক (বাণিজ্য) এস এম আশিকুজ্জামান দাবি করেছেন, আগামী বছরের শুরুতেই নতুন পাঁচটি ডাম্ব ফেরি দেশে আনা হবে।

বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ঘাট কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, একমাত্র শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটেই শত বছরের পুরোনো ৬টি ডাম্ব ফেরি চলাচল করে। এগুলো হচ্ছে ‘রামশ্রী’, ‘টাপলো’, ‘রানীগঞ্জ’, ‘যমুনা’, ‘রানীক্ষেত’ ও ‘রায়পুরা’। ১ থেকে ৩০ বছর পুরোনো কে-টাইপ ৬টি ফেরি হলো ‘ক্যামেলিয়া’, ‘কুঞ্জলতা’, ‘কদম’, ‘কাকলী’, ‘কিশোরী’ ও ‘কুমিল্লা’ এবং ৮ থেকে ৫০ বছর পুরোনো রো রো ফেরিগুলো হলো ‘ভাষাসৈনিক গোলাম মাওলা’, ‘শাহ্ পরাণ’, ‘এনায়েতপুরী’, ‘শাহ্ জালাল’, ‘বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর’ ও ‘ফরিদপুরী’। এ ছাড়া আরও একটি ছোট ফেরি ‘কর্ণফুলী’ মাঝে মাঝে চলাচল করে। এ বছর কে-টাইপ ফেরি ‘কুঞ্জলতা’ ও ‘কদম’ নতুন যোগ করা হয়। এ ছাড়া ‘ক্যামেলিয়া’ ২০১৫ সালে এবং ‘কিশোরী’ ২০১৮ সালে নৌপথে নামানো হয়।

স্বাভাবিক সময়ে এ রুটে প্রতিটি রো রো ফেরিতে গড়ে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০টি, কে-টাইপ ফেরি ১০০ থেকে ১২০টি এবং ডাম্ব ফেরিতে ১৫০ থেকে ২০০টি ছোট-বড় যানবাহন পারাপার করে। মাদারীপুরের বাংলাবাজার ও ও মুন্সিগঞ্জে শিমুলিয়া নৌপথ ব্যবহার করে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ যানবাহন পারাপার হয়ে থাকে। এর মধ্যে বাস থাকে অর্ধেক; বাকি ট্রাক ও প্রাইভেট কার-মাইক্রোবাসসহ অন্যান্য ছোট গাড়ি। এসব যান ও গাড়ি ছাড়াও হাজারখানেক মানুষ প্রতিদিন নদী পারাপার করে।

নৌরুটের বিআইডব্লিউটিসি সূত্রে জানা যায়, মুন্সিগঞ্জ ও মাদারীপুর জেলাকে সংযুক্তকারী নৌরুট ১৯৯০ সালে কাওড়াকান্দি এলাকায় চালু করা হয়। তারপর ২০১৭ সালে ৫ কিলোমিটার দূরত্ব কমিয়ে কাঁঠালবাড়ী এলাকায় ঘাট তৈরি করা হয়। ২০২০ সালে সেখান থেকে নতুন করে মাত্র ৫ মিটার দূরে ‘বাংলাবাজার’ এলাকায় স্থানান্তরিত করা হয় ঘাট।

নৌপথ সচল রাখতে আর যাতায়াত সহজ করার জন্যে এ রুটটি বিভিন্ন সময়ে সরানো হয়েছে। এ রুটে ৩০ বছর ধরে পুরোনো ডাম্ব ফেরি ও নতুন পুরাতন ফেরিগুলো চলাচল করেছে।

দুই ঘাটের সূত্র মতে, গত জুলাইয়ের শেষ দিক ও আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ২৪ দিনে পদ্মায় তীব্র স্রোত অব্যাহত থাকায় পদ্মা সেতুর তিনটি পিলারে চারবার ফেরির ধাক্কা লাগে। এতে আহত হন বেশ কয়েকজন যাত্রী। ফেরির ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেতুর পাইল ক্যাপ।

এই পরিস্থিতিতে নৌপথে সব ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে ১৮ আগস্ট দুপুরের পর থেকে এই নৌপথে ফেরি চলাচল পুরোপুরি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে ৩ অক্টোবর থেকে পরীক্ষামূলক তিন থেকে পাঁচটি ফেরি চলাচল করে। এতেও ঝুঁকি মনে করে গত ২৫ অক্টোবর থেকে এ রুটের সব ফেরি বন্ধ করে ছয়টি ডাম্ব ফেরি, চারটি রো রো ফেরি ও তিনটি কে-টাইপ ফেরি নোঙর করে রাখা আছে। তবে বছরের স্বাভাবিক সময়ে এই নৌরুটে সব মিলিয়ে ১৮টি ফেরি চলাচল করে।

ফেরি চলাচল বন্ধ থাকায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে অপেক্ষমাণ ট্রাকচালক ও শ্রমিকদের।

বাংলাবাজার ঘাটের টার্মিনালে অপেক্ষমাণ বরিশাল থেকে আসা ট্রাকচালক আব্দুর রহিম বলেন, ‘আগে জানতাম নদীতে লঞ্চ-স্পিডবোট ডুবে, এখন দেখি ফেরিও ডুবে। তা হলে আমাদের জীবনের নিরাপত্তা কী? আমরা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ এ রুট হয়ে ঢাকায় যাতায়াত করি। ফেরি ডুবে যাওয়ার ঘটনায় আমরাও শঙ্কিত। সরকারের উচিত, ফেরি মেরামত করা অথবা নতুন ফেরি দেয়া।’

আরেক চালক সফুলউদ্দিন বলেন, ‘আমি ২৮ অক্টোবর এসে এখন আটকে আছি। মাঝে মাঝে ছোট ফেরি চলে আবার বন্ধ থাকে। কীভাবে পদ্মা পাড়ি দেব, এটা নিয়েই টেনশনে আছি। আবার ফেরি ডুবে যাওয়ার কথা আগে শুনতাম না, এখন প্রায়ই ফেরি ডুবে। আমরা নদীতে যানবাহন নিয়ে মরতে চাই না।’

মাদারীপুর জেলা উন্নয়ন-সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘শুনেছি দেশের অধিকাংশ ফেরির মেয়াদ শেষ। এ জন্য পুরোপুরি দায়ী বিআইডব্লিউটিসি ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। লঞ্চসহ অন্য নৌযানের যেমন ফিটনেস প্রয়োজন, তেমন ফেরিরও ফিটনেস ও মেয়াদোত্তীর্ণের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে, না হলে ফেরি দুর্ঘটনার জন্যে সরকারসহ কর্তৃপক্ষকে দায় নিতে হবে। কোনো রকম তদন্ত কমিটি করে দায়ভার এড়াতে পারবে না।’

এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের এজিএম (মেরিন বিভাগ) আহমদ আলী জানান, ‘দেশের একমাত্র শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে ৬টি ডাম্ব ফেরি বা টানা ফেরি চলাচল করে। এর বাইরে অন্য কোথাও এসব ফেরি চলাচল করে বলে জানা নেই। এসব ফেরির আয়ু ১০০ বছরের বেশি। এগুলোকে ইঞ্জিলচালিত নৌযান দিয়ে টেনে চালানো হয়, যে কারণে ফেরির তলা ফেটে বা নষ্ট হলেও বারবার মেরামত করা যায়। প্রতিটি ডাম্ব ফেরি তিন বছর পরপর তলা চেক করে মেরামত করা হয়।’

যানবাহন ও যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়ে আহমদ আলী আরও বলেন, ‘সাধারণত ফেরির তলায় বড় ধরনের আঘাত না পেলে ফেটে যায় না। আর ফেটে গেলেও ডুবতে সময় লাগে। আর মাঝারি কে-টাইপ এবং রো রো ফেরির ত্রুটি হলে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে কাত হয়ে ডুবে যায়।

‘মেয়াদোত্তীর্ণ ফেরি কম থাকায় ত্রুটিপূর্ণ ফেরি দিয়েই আমাদের নৌপথ সচল রাখতে হয়। ফেরির মাস্টাররা সাবধানে নদীতে চলাচল করেন। তবে এটুকু বলা যায়, লঞ্চ বা স্পিডবোট যেভাবে দ্রুত ডুবে যায়, সেটা ফেরিতে হয় না। ডুবতে হলেও সময় লাগে।’

বিআইডব্লিউটিসি বলছে, প্রয়োজনের তুলনায় ফেরির স্বল্পতা আছে। ফলে বাধ্য হয়ে চালানো হচ্ছে ভাঙাচোরা ফেরি।

বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক (বাণিজ্য) এস এম আশিকুজ্জামান মুঠোফোনে বলেন, ‘পদ্মা নদীতে বছরজুড়েই ড্রেজিং কার্যক্রম চলে, ফলে মাঝে মাঝে ফেরির তলা ফেটে যায়। পরে সেগুলো মেরামত করে আবার নৌপথে নামানো হয়। ফেরির মেয়াদোত্তীর্ণ বলে কোনো বিষয় নেই। পাঁচ-ছয় বছরের ফেরিগুলোও যেমন মাঝেমধ্যেই সমস্যা হয়, তেমনি ৪০ বছরের ফেরিগুলোরও তেমন সমস্যা হয়। সমস্যা হলেই বিআইডব্লিউটিএর চিফ ইঞ্জিনিয়ার এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন এবং সমস্যার সমাধান করেন।’

ডাম্ব ফেরির বিষয়ে এস এম আশিকুজ্জামান বলেন, ‘এসব ফেরি এখন খুব একটা চালানো হয় না। যখন ঘাটে চাপ বেশি থাকে, তখন চালানো হয়। এ ছাড়া এসব ফেরি একটি শক্তিশালী ইঞ্জিন দিয়ে টেনে নেয়া হয়। ফলে ফেরি ক্ষতিগ্রস্ত হলে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। তারপরও আগামী বছর আরও অন্তত পাঁচটি নতুন ফেরি দেশে আনা হবে। তখন এসব ডাম্ব ফেরি বন্ধ করার সুপারিশ করা যাবে। আপাতত এসব দিয়েই চলতে হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর