কুমিল্লা নগরের নানুয়ার দিঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত ইকবাল হোসেন কক্সবাজারে গ্রেপ্তার হন ২১ অক্টোবর। কিন্তু এর চার দিন আগে চকরিয়ায় চোর সন্দেহে তাকে আটক করেন স্থানীয়রা। পরে পাগল ভেবে তাকে ছেড়ে দেয় পুলিশ।
অভিযুক্ত ইকবাল হোসেনের নতুন একটি ভিডিও সম্প্রতি নিউজবাংলার হাতে আসে। সেই ভিডিওর সূত্র ধরে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এসব তথ্য।
প্রায় ৩০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, চকরিয়ার একটি এলাকায় হাঁটুর ওপর হাত রেখে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছেন ইকবাল। তাকে ঘিরে কয়েকজন কথা বলছেন।
ভিডিওতে ইকবালের পরিচয় জানতে চান এলাকাবাসী। ইকবাল তাদের নিজের নাম ও একটি মোবাইল ফোন নম্বর দেন।
এ সময় তার পরনে ছিল জলপাই রঙের টি-শার্ট ও ছাই রঙের প্যান্ট। ডান কাঁধের ওপর ছিল ভাঁজ করে রাখা একটি চেক গামছা।
ভিডিওটি কবে, কে কোথায় করেছেন তা জানার চেষ্টা করেছে নিউজবাংলা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, কুমিল্লায় সহিংসতার ঠিক চার দিন পর অর্থাৎ ১৭ অক্টোবর কক্সবাজারের চকরিয়ায় একজনের মোবাইল ফোনে ধারণ করা হয় ভিডিওটি।
চকরিয়ায় ইকবালকে যারা আটক করেছিলেন তাদের একজন মো. রমজান। তিনি নিউজবাংলাকে জানান, ১৭ অক্টোবর রাতে চকরিয়া শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে খুটাখালীর একটি বাড়িতে ঢোকেন এক যুবক। ওই বাড়ির লোকজন ও স্থানীয়রা তাকে চোর ভেবে আটকে রাখেন। তখন তার হাতে গামছা পেঁচানো একটি কোরআন শরিফ ছিল।
যাচাই করে তারা নিশ্চিত হন কোরআন শরিফটি তাদের নয়। তখন প্রশ্ন করা হয়, এটি তিনি কোথায় পেয়েছেন। জবাবে যুবক জানান, তার নানা এটি তাকে পড়তে দিয়েছেন।
রমজান দাবি করেন, কুমিল্লায় সহিংসতার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত ইকবালের ছবি তখনও ফেসবুকে ভাইরাল হয়নি। ফলে তারা জানাতে পারেননি এই যুবকই সেই ইকবাল।
ইকবালকে চাচাতো ভাইয়ের বাড়িতে আটকে রাখেন রমজান। সেখানে কেউ একজন ওই ভিডিওটি ধারণ করেন বলে জানান তিনি। রমজান বলেন, ‘আটক ইকবালের তথ্য দিতে আমি জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ ফোন করি। তখন আমার সঙ্গে কথা হয় চকরিয়া থানার ডিউটি অফিসার মঈন উদ্দিনের।’
চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-তদন্ত) জুয়েল ইসলাম নিউজবাংলাকে এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, ১৭ অক্টোবর রাতে চকরিয়া থেকে রমজান নামে এক ব্যক্তি ৯৯৯ ফোন দেন। ফোনে ওই ব্যক্তি জানান, চোর সন্দেহে একজনকে আটক করেছেন তারা। পুলিশ সেখানে গিয়ে তার নাম জানতে চাইলে তিনি জানান ইকবাল হোসেন, বাড়ি কুমিল্লা।
পাগল ভেবে রাত ১১টার দিকে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। এর আগে তার কাছ থেকে নেয়া হয় কোরআন শরিফ ও গামছা। যাওয়ার আগে ইকবালকে দেয়া হয় একটি শার্ট।
ইকবালকে ২১ অক্টোবর যখন সুগন্ধা বিচ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়, তখন তার পরনে ওই চেকশার্ট ছিল। গ্রেপ্তারের পর ইকবালকে নেয়া হয় কুমিল্লায়।
কুমিল্লায় সহিংসতার ঘটনা তদন্ত করছেন এমন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ১৩ অক্টোবর বেলা সাড়ে ৩টায় কর্ণফুলী ট্রেনে কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামে যান ইকবাল। সারা রাত চট্টগ্রাম স্টেশন ও আশপাশের এলাকায় কাটিয়ে দেন। পরদিন একটি ট্রাকে উঠে চকরিয়ায় নামেন।
সেখানে একটি মাদ্রাসা থেকে কোরআন শরিফ নেন। সন্ধ্যার দিকে কোরআন বের করে একটি বাড়ির সামনে পড়ছিলেন। চারপাশে মানুষের ভিড় জমে। তবে তখন ইকবালের ছবি ভাইরাল হয়নি। ফলে লোকজন জানতে পারেনি এই ব্যক্তিকে।
দুর্গাপূজায় সারা দেশে উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্যে গত ১৩ অক্টোবর ভোরে কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ পাওয়ার পর ছড়িয়ে পড়ে সহিংসতা।
নানুয়ার দিঘির পাড়ের ওই মণ্ডপে চলে ব্যাপক ভাঙচুর, আক্রান্ত হয় নগরীর আরও বেশ কিছু পূজামণ্ডপ। পরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে চাঁদপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায়।
যেখান থেকে সাম্প্রদায়িক এই সহিংসতার শুরু, সেই নানুয়ার দিঘির পাড়ের মণ্ডপে কীভাবে উত্তেজনার শুরু এবং মূল মণ্ডপের বাইরে পূজার থিম হিসেবে রাখা হনুমানের মূর্তির ওপর পবিত্র কোরআন শরিফ কী করে এলো, সে বিষয়ে টানা অনুসন্ধান চালায় নিউজবাংলা।
- আরও পড়ুন:কুমিল্লায় মণ্ডপে কোরআন রাখল কারা
পূজার আয়োজক, এলাকাবাসী, তদন্তকারী কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার আগের রাত আড়াইটা পর্যন্ত মন্দিরে পূজাসংশ্লিষ্টদের উপস্থিতি ছিল। এরপর ১৩ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৬টার দিকে দুজন নারী ভক্ত মণ্ডপে এসে হনুমানের মূর্তিতে প্রথম কোরআন শরিফটি দেখতে পান।
পূজার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন দিঘির পাড়ের বাসিন্দা তরুণ কান্তি মোদক। স্থানীয়রা তাকে মিথুন নামে চেনেন। মিথুন নিউজবাংলাকে জানান, রাত আড়াইটা পর্যন্ত তিনি মণ্ডপে ছিলেন। তখন পর্যন্ত সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। এরপর তিনি নৈশপ্রহরী শাহিনের কাছে মণ্ডপের নিরাপত্তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বাসায় ফেরেন। সহিংসতার পর নৈশপ্রহরী শাহিনকেও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
নিউজবাংলার হাতে আসা সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, সহিংসতার আগের রাতে শাহ আবদুল্লাহ গাজীপুরি (রা.)-এর মাজারের মসজিদ থেকে একটি কোরআন শরিফ নিয়ে পাশের নানুয়ার দিঘির পাড়ের মণ্ডপে উদ্দেশে রওনা হন ইকবাল।
এর প্রায় এক ঘণ্টা পরের আরেকটি ফুটেজে মণ্ডপে রোরআন রেখে হনুমানের গদা হাতে ইকবালকে ফিরতে দেখা যায়।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কুমিল্লার নানুয়ার দিঘির পাড়ের যে অস্থায়ী পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ পাওয়া যায়, সেখানে শুরুতে প্রবেশে ব্যর্থ হয়েছিলেন প্রধান অভিযুক্ত ইকবাল হোসেন। এরপর তিনি গিয়েছিলেন ওই মণ্ডপ থেকে কিছুটা দূরে দিগম্বরীতলার গুপ্ত জগন্নাথ মন্দিরে।
মন্দিরটির গেটের তালা লাঠি দিয়ে ভাঙতে ব্যর্থ হন ইকবাল। এরপর আবার ফিরে আসেন নানুয়ার দিঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে। এ সময় পূজাসংশ্লিষ্টদের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে তিনি কোরআন শরিফটি হনুমানের ওপর রাখেন। মসজিদ থেকে বের হওয়ার প্রায় এক ঘণ্টা পর কোরআন রেখে হনুমানের গদা হাতে ফিরে আসেন ইকবাল।
৩০ বছর বয়সী ইকবাল হোসেন কুমিল্লা নগরীর ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের দ্বিতীয় মুরাদপুর-লস্করপুকুর এলাকার নূর আহম্মদ আলমের ছেলে। নূর আলম পেশায় মাছ ব্যবসায়ী। ইকবালকে ২১ অক্টোবর কক্সবাজার থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।