ভবিষ্যতে শিশুদের পুলিশে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করতে দেশের প্রতিটি প্রাইমারি স্কুলে পুলিশ কর্মকর্তাদের যাওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
তিনি বলেছেন, ‘ছোট বাচ্চারা পুলিশের পোশাক দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। কি সুন্দর পোশাক। এটা আমার খুব ভাল লেগেছে। কাজেই ছোট বাচ্চাদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য পুলিশের অনেক ভূমিকা রয়েছে।
‘প্রতিটা প্রাইমারি স্কুলে পুলিশ অফিসারদের যাওয়া উচিত। গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলা উচিত। সেখানে নারী পুলিশ গেলে মেয়েরা উদ্বুদ্ধ হবে। তারা ভাববে, কে বলেছে, মেয়েরা শুধু ঘরে বসে রান্না করবে, তারা পুলিশ অফিসার হতে পারবে।’
শনিবার রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে শহীদ শিরু মিয়া মিলনায়তনে আয়োজিত কমিউনিটি পুলিশিং ডে-২০২১-এর উদ্বোধন ও আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমি যদি ভালো মানুষ না হই, যত কথাই বলি না কেন কেউ আমার কথা শুনবে না। যদি আমরা জনসেবা করতে চাই আমাদের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে। ইতোমধ্যে পুলিশের অনেকে এই কাজ করে যাচ্ছেন।’
জাফর ইকবাল বলেন, ‘যখন আমি রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ঢুকি, তখন মনে হয় আমি একটা তীর্থস্থানে এসেছি। এই জায়গা সেই যায়গা যেখানে পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে প্রথম বুলেট নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। পুলিশ বাহিনীর পাকিস্তান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধ করার ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু তারা প্রথম প্রতিরোধ করেছিল।’
একাত্তরের ২৫ মার্চের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার বাবা একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে আমাদের সবার ঘুম ভেঙে গেল মাইকের একটা অ্যানাউন্স শুনে যে, বাংলাদেশে পাকিস্তান আর্মিরা গণহত্যা শুরু করেছে। আমার বাবাকে পাকিস্তানি বাহিনী গুলি করে একটা নদীতে ফেলে গিয়েছিল।
‘বাবার মরদেহ পানিতে ভেসেছে তিন দিন ধরে। মৃতদেহ তিন দিন পড়ে থাকলে সাধারণত স্বাভাবিক থাকে না। মানুষ সেটা ধরতে চায় না। কিন্তু আমার বাবা পুলিশের পোশাক পরে ছিলেন, মানুষ আবার বাবাকে ভালবাসতেন। কারণ তিনি একজন সৎ পুলিশ অফিসার ছিলেন। মানুষজন ধরে তাকে নদীর তীরে এনেছিলেন।’
জাফর ইকবাল বলেন, ‘এই কথাগুলো বলার কারণ, আমাকে ভালো মানুষ হতে হবে। আমি যদি ভালো মানুষ না হই, আমি যত ভালো কথাই বলি মানুষ আমার কথা শুনবে না। আমি যদি কিছু করতে চাই আমাকে ভালমানুষ হতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘যখন আমি শুনেছি বাংলাদেশে কমিউনিটি পুলিশিং শুরু হয়েছে, আমি খুবই আনন্দিত হয়েছি। আমি কি একজনকে রোগাক্রান্ত করে হাসপাতালে নিয়ে আইসিইউতে রেখে, সিসিইউতে রেখে লাখ লাখ টাকা খরচ করে তাকে বাসায় আনব? নাকি চেষ্টা করব তার রোগটাই না হয়? অবশ্যই চেষ্টা করব, রোগটাই না হয়।’
জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমরা কী কাউকে অপরাধ করতে দিয়ে শাস্তি দিব? নাকি আমরা এমন একটা পরিবেশ তৈরি করব, যেখানে অপরাধের সংখ্যা কমে আসে?’
দেশের মানুষের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘কিছু হলেই আমরা বিদেশের সঙ্গে তুলনা করি। বিদেশে অমুক আছে, তমুক আছে। আমি কিন্তু বিদেশের সঙ্গে তুলনা করতে রাজি না। পৃথিবীর অনেক আধুনিক দেশ আছে যে দেশের অবস্থা ভালো না। যুক্তরাষ্ট্রের জেলখানায় যত মানুষ আছে, আমার মনে হয় না পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের জেলখানায় এত মানুষ আছে।’
জাফর ইকবাল বলেন, ‘নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্কের মতো দেশ যথেষ্ট অপরাধী না থাকায় জেলখানা বন্ধ করে দেয়ার চিন্তা করছে। আমরাও এমন একটা দেশ চাই, যেখানে মানুষ অপরাধ করবে না।’
পুলিশের জনসেবার কথা উল্লেখ করে এই লেখক বলেন, ‘যদি আমরা জনসেবা করতে চাই, আমাদের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে। ইতোমধ্যে অনেকে এই কাজ করে যাচ্ছেন। এক এলাকায় এক পুলিশ অফিসার দেখেন, তার এলাকায় যারা মোটরসাইকেল চালান, বেশিরভাগ মানুষের ড্রাইভিং লাইসেন্স নাই। কারণ কীভাবে লাইসেন্স করতে হয় তিনি জানেন না। তখন তিনি সবাইকে ডেকে নিজে ফরম পূরণ করে লাইসেন্স পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।’
জাফর ইকবাল বলেন, ‘এই কাজ পুলিশের কোথাও লেখা নাই, কিন্তু তিনি করেছেন। আমি অনেক জায়গায় দেখেছি পুলিশ সদস্যরা এসে স্কুলের বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলেন। গরিব বাচ্চাদের খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘যদি অনেক ভালো, অনেক বড় কিছু করতে চান তবে সেটা ভলেন্টিয়ারদের দিয়ে করতে হবে। টাকা দিয়ে সব হয় না। ভলেন্টিয়াররা যে কাজ করে সেটা মন থেকে করে। কাজেই এই কমিউনিটি পুলিশিং করার জন্য নিশ্চয়ই অনেক ভলেন্টিয়ার দরকার। সারা দেশে ভলেন্টিয়াররা পুলিশের পাশাপাশি বসে সেই কাজ করবে।’
বঙ্গবন্ধুর কথা উল্লেখ করে জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমাদের খুবই দুর্ভাগ্য বঙ্গবন্ধু মতো মানুষ সময় পেলেন না। দেশের মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সে তার চলে যেতে হল। সব কিছুতেই তার পরিষ্কার জ্ঞান ছিল।
‘তিনি পাকিস্তান কারাগার থেকে ফিরে এসে প্রথম শিক্ষানীতি তৈরি করলেন। দায়িত্ব দিলেন বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদাকে। তিনি বুঝেছিলেন বিজ্ঞানটা কত প্রয়োজন। কুদরত-এ-খুদা একটি সুন্দর শিক্ষানীতি তৈরি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আনফরচুনেটলি সেটা কার্যকর হয় নাই। যদি তার শিক্ষা নীতি কার্যকর হতো, তাহলে এতদিন পরে এসে আমাদের জঙ্গি নিয়ে দুর্ভাবনা করতে হত না।’
তিনি বলেন, ‘দেশে যে পরিমাণ পুলিশ সদস্য থাকার কথা আমাদের দেশে তার ১০ ভাগের এক ভাগ আছে। বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে ইভটিজিং বন্ধ করে দিতে পারবেন। কারণ, ওই এলাকার লোকজন জানে কারা ইভটিজিং করে। এলাকায় বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়ে যাবে, কারণ ওই এলাকার মানুষ জানবে কে বাল্যবিবাহ দিচ্ছে।’