কুমিল্লা নগরের নানুয়াদিঘির পাড়ে অস্থায়ী পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত ইকবাল হোসেনসহ চারজনকে আরও পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত।
মুখ্য বিচারিক হাকিম ১ নম্বর আমলি আদালতের বিচারক বেগম ফারহানা সুলতানা এই আদেশ দেন।
নিউজবাংলাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এনামুল হক।
এর আগে ২৩ অক্টোবর ইকবালসহ চার আসামিকে ৭ দিনের রিমান্ডে পায় পুলিশ। সেই রিমান্ড শেষ হওয়ার দিনেই শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে কড়া নিরাপত্তায় আসামিদের আদালতে তোলা হয়।
পুলিশ সুপার এনামুল হক বলেন, ‘ইকবালসহ চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। তাদের আরও জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন রয়েছে। তাই আমরা শুক্রবার আদালতের কাছে আরও ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করি। বিচারক শুনানি শেষে ৫ দিনের রিমান্ডে পাঠান।
মামলাটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। তারাই আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে। রিমান্ড শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে বিস্তারিত বলা হবে।’
কুমিল্লা জেলা পুলিশের ডিআইও-১ মনির আহমেদ জানান, কুমিল্লায় কোরআন অবমাননা, পূজামণ্ডপে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও খুনের ঘটনায় ১২টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৮৬ জনকে।
দুর্গাপূজায় সারা দেশে উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্যে গত ১৩ অক্টোবর ভোরে কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ পাওয়ার পর ছড়িয়ে পড়ে সহিংসতা।
নানুয়ার দিঘির পাড়ের ওই মণ্ডপে চলে ব্যাপক ভাঙচুর, আক্রান্ত হয় নগরীর আরও বেশকিছু পূজামণ্ডপ। পরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে চাঁদপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায়।
যেখান থেকে সাম্প্রদায়িক এই সহিংসতার শুরু, সেই নানুয়ার দিঘির পাড়ের মণ্ডপে কীভাবে উত্তেজনার শুরু এবং মূল মণ্ডপের বাইরে পূজার থিম হিসেবে রাখা হনুমানের মূর্তির ওপর পবিত্র কোরআন শরিফ কী করে এলো, সে বিষয়ে টানা অনুসন্ধান চালায় নিউজবাংলা।
- আরও পড়ুন:কুমিল্লায় মণ্ডপে কোরআন রাখল কারা
পূজার আয়োজক, এলাকাবাসী, তদন্তকারী কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার আগের রাত আড়াইটা পর্যন্ত মন্দিরে পূজাসংশ্লিষ্টদের উপস্থিতি ছিল। এরপর ১৩ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৬টার দিকে দুজন নারী ভক্ত মণ্ডপে এসে হনুমানের মূর্তিতে প্রথম কোরআন শরিফটি দেখতে পান।
পূজার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন দিঘির পাড়ের বাসিন্দা তরুণ কান্তি মোদক। স্থানীয়রা তাকে মিথুন নামে চেনেন। মিথুন নিউজবাংলাকে জানান, রাত আড়াইটা পর্যন্ত তিনি মণ্ডপে ছিলেন। তখন পর্যন্ত সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। এরপর তিনি নৈশপ্রহরী শাহিনের কাছে মণ্ডপের নিরাপত্তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বাসায় ফেরেন। সহিংসতার পর নৈশপ্রহরী শাহিনকেও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
নিউজবাংলার হাতে আসা সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, সহিংসতার আগের রাতে শাহ আবদুল্লাহ গাজীপুরি (রা.)-এর মাজারের মসজিদ থেকে একটি কোরআন শরিফ নিয়ে পাশের নানুয়ার দিঘির পাড়ের মণ্ডপে উদ্দেশে রওনা হন ইকবাল।
এর প্রায় এক ঘণ্টা পরের আরেকটি ফুটেজে মণ্ডপে কোরআন রেখে হনুমানের গদা হাতে ইকবালকে ফিরতে দেখা যায়।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কুমিল্লার নানুয়ার দিঘির পাড়ের যে অস্থায়ী পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ পাওয়া যায়, সেখানে শুরুতে প্রবেশে ব্যর্থ হয়েছিলেন প্রধান অভিযুক্ত ইকবাল হোসেন। এরপর তিনি গিয়েছিলেন ওই মণ্ডপ থেকে কিছুটা দূরে দিগম্বরীতলার গুপ্ত জগন্নাথ মন্দিরে।
মন্দিরটির গেটের তালা লাঠি দিয়ে ভাঙতে ব্যর্থ হন ইকবাল। এরপর আবার ফিরে আসেন নানুয়ার দিঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে। এ সময় পূজাসংশ্লিষ্টদের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে তিনি কোরআন শরিফটি হনুমানের ওপর রাখেন। মসজিদ থেকে বের হওয়ার প্রায় এক ঘণ্টা পর কোরআন রেখে হনুমানের গদা হাতে ফিরে আসেন ইকবাল।
৩০ বছর বয়সী ইকবাল হোসেন কুমিল্লা নগরীর ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের দ্বিতীয় মুরাদপুর-লস্করপুকুর এলাকার নূর আহম্মদ আলমের ছেলে। নূর আলম পেশায় মাছ ব্যবসায়ী। ইকবালকে গত বৃহস্পতিবার কক্সবাজার থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ধর্ম অবমাননার মামলায় ইকবালসহ চারজনকে শনিবার সাত দিনের রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ। অন্য আসামিরা হলেন, মণ্ডপে কোরআন পাওয়ার তথ্য ৯৯৯-এ কল করে জানানো ইকরাম হোসেন এবং নগরীর শাহ আবদুল্লাহ গাজীপুরি (রা.)-এর মাজারের সহকারী খাদেম হুমায়ুন আহমেদ ও ফয়সাল আহমেদ।