দেশে তীব্র গ্যাস সংকট, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দরে সাত বছরের রেকর্ড অতিক্রম, আমদানি করা তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দর বৃদ্ধি চাপে ফেলেছে সরকারের জ্বালানি বিভাগকে।
এ অস্থিরতাকে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন, সংকট দেশের সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকে বেগবান করবে। সংকটকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে আসন্ন শুষ্ক মৌসুমেই শুরু হচ্ছে সাগরে বহুমাত্রিক জরিপ বা মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে।
অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি পণ্যের দর বাড়ায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোরও বাংলাদেশমুখী হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে অগভীর সমুদ্রে ভারতের জাতীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি ওএনজিসির দুই ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনায় সাগরে গ্যাস-তেল অনুসন্ধানে গতি ফিরবে বলে মনে করে সরকারের জ্বালানি বিভাগ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৭ থেকে ৯ বছরেরও বেশি আগে প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ মীমাংসা হয়। এরপর দেশ দুটি সমুদ্রসীমায় জরিপ ও অনুসন্ধান করে সফল হলেও ঘুম ভাঙেনি বাংলাদেশের।
তবে জ্বালানি সচিব আনিছুর রহমানের দাবি, সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের প্রস্তুতি সরকারের নেয়াই আছে।
তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারি ও বিশ্ববাজারে জ্বালানির দর পড়ে যাওয়ায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এতদিন আগ্রহী ছিল না, তবে করোনা নিয়ন্ত্রণে আসা ও জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়ায় এখন কোম্পানিগুলোর বাংলাদেশমুখী হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। বিশেষ করে অগভীর সমুদ্রে ওএনজিসির দুই ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করবে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে এখন তীব্র গ্যাস সংকট চলছে। এতে উৎপাদন খাত হুমকিতে আছে। এই সংকট মোকাবিলায় উচ্চ মূল্যে গ্যাস আমদানি করছে সরকার। অন্যদিকে স্থলভাগেও কমছে নিজস্ব গ্যাসের মজুত। তারপরও বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। এরই মধ্যে একাধিক বিদেশি কোম্পানি সাগরে অনুসন্ধান শেষ না করেই চলে গেছে।
পূর্ণাঙ্গ জরিপের জন্য প্রয়োজনীয় মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের কাজ ঝুলে আছে ছয় বছর ধরে। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র ডাকার কার্যক্রমও বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। অথচ বঙ্গোপসাগর থেকে গ্যাস তুলছে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার। ভারতও প্রচুর পরিমাণ গ্যাস আবিষ্কার করেছে।
শুরু হচ্ছে মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে
অবশেষে বহু নাটকীয়তার পর গভীর ও অগভীর সমুদ্রে পূর্ণাঙ্গ বহুমাত্রিক জরিপ বা মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে হতে যাচ্ছে। নরওয়ের কোম্পানি টিজিএস ও ফ্রান্সের স্কামবার্জার যৌথভাবে করা এক কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে এই জরিপ করতে যাচ্ছে।
আসন্ন শুষ্ক মৌসুমেই মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের কাজ শুরু করবে টিজিএস কনসোর্টিয়াম। অগভীর ও গভীর সমুদ্রের প্রায় ৮০ ভাগ এলাকায়, এক্সক্লুসিভ সিসমিক সার্ভে করবে তারা। ফলে সমুদ্রের কোন কোন অংশে হাইড্রোকার্বন রয়েছে, তা প্রাথমিকভাবে জানা যাবে।
আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুযায়ী, সার্ভে পরিচালনার যাবতীয় ব্যয় কোম্পানিটি বহন করবে। সার্ভে শুরু হলে দুই বছরের মধ্যে ফল পাওয়া যাবে। তারা জরিপের ফল বিক্রি করতে পারবে।
পেট্রোবাংলা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্রে ভালো সাড়া না মেলায় সরকার পুরো সমুদ্রসীমায় একটি পূর্ণাঙ্গ বহুমাত্রিক জরিপ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সার্ভের কাজ করার জন্য ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে পেট্রোবাংলা।
দরপত্র জমা পড়ে পাঁচটি। দরপত্র মূল্যায়নে নরওয়ের কোম্পানি টিজিএস ও ফ্রান্সের স্কামবার্জার কনসোর্টিয়াম যোগ্য বলে নির্বাচিত হয়। এরপর পেট্রোবাংলা প্রস্তাব চূড়ান্ত করে চুক্তিপত্র অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন নিতে জ্বালানি বিভাগে ফাইল পাঠায়, কিন্তু সে প্রক্রিয়া বাতিল করে আবার দরপত্র আহ্বানের জন্য পেট্রোবাংলাকে নির্দেশ দেয় জ্বালানি বিভাগ।
পরে পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হলে এবারও পাঁচটি প্রস্তাব জমা পড়ে। এবারও দর প্রক্রিয়ায় টিজিএস-স্কামবার্জার কনসোর্টিয়াম প্রথম হয়। এরপর চুক্তির প্রস্তাব জ্বালানি বিভাগের মাধ্যমে ২০১৬ সালের ৩ আগস্ট অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে উত্থাপন করা হয়। সেবারও দরপত্র প্রক্রিয়া সঠিক হয়নি বলে আপত্তি তোলা হয়।
পরে দরপত্র মূল্যায়নের যথার্থতা যাচাইয়ের জন্য আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। প্রায় ৯ মাস পর আইন মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রতিবেদন মন্ত্রিসভা কমিটির কাছে পাঠানো হয়।
এরপরও দীর্ঘদিন এই প্রস্তাব আটকে থাকার পর অবশেষে ২০১৯ সালের এপ্রিলে এটি মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন পায়। ২০২০ সালের মার্চে টিজিএস ও স্কামবার্জার কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তি করে পেট্রোবাংলা।
এর আগে মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে নিয়ে এ জটিলতার মধ্যে নিজেরাই জরিপ পরিচালনার পরিকল্পনা করে জ্বালানি বিভাগ। এ জন্য ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতেও নেয়া হয়।
এর আওতায় ৯৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে অত্যাধুনিক জাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর সার্ভে জাহাজ ভাড়ার উদ্যোগ নেয়া হয়, কিন্তু কোনোটাই আলোর মুখ দেখেনি।
আশা দেখাচ্ছে ওএনজিসি
এখন সাগরে কাজ করছে কেবল ভারতের প্রতিষ্ঠান ওএনজিসি। তারা এসএস-৪ ও এসএস-৯ ব্লকে কাজ করছে। আগামী ডিসেম্বরে অগভীর সমুদ্রের ৪ নম্বর ব্লকে একটি অনুসন্ধান কূপ খননকাজ শুরু করবে ওএনজিসি। আগামী জুনে ব্লক ৪-এ আরেকটি অনুসন্ধান কূপ খনন করবে তারা। আগামী বছরের ডিসেম্বরে এসএস-৯ নম্বর ব্লকেও একটি কূপ খনন করার পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
তবে এরই মধ্যে ওএনজিসির ব্লক দুটিতে ২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস পাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখছে জ্বালানি বিভাগ। পেট্রোবাংলার কাছে ওএনজিসি যে তথ্য-উপাত্ত জমা দিয়েছে, তাতে বলা হচ্ছে, অগভীর সমুদ্রে তিনটি কূপ খনন করে পাওয়া যেতে পারে ১ দশমিক ৯ টিসিএফ গ্যাস। পেট্রোবাংলা সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একটি বৈঠকে এসব তথ্য উপস্থাপন করে।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (প্রোডাকশন শেয়ারিং কনট্রাক্ট) প্রকৌশলী মো. শাহিনুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত ২৯ সেপ্টেম্বর মহেশখালীতে কাঞ্চন-১ কূপ খনন শুরু হয়েছে। তার আশা, সেখানে তিনটি লেয়ারে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর গভীরতা ৪ হাজার ২০০ মিটার পর্যন্ত।
‘গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য তিন মাস এবং বাণিজ্যিক উপযোগিতা নিরূপণের জন্য আরও তিন মাসসহ মোট ছয় মাস প্রয়োজন।’
২০১২ সালে ওএনজিসি ভিদেশ এবং ইন্ডিয়ান অয়েলের সঙ্গে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট চুক্তি হয়। এর মাধ্যমে অগভীর সমুদ্রের ৪ ও ৯ নম্বর ব্লকে প্রতিষ্ঠান দুটিকে অনুসন্ধানের সুযোগ দেয়া হয়।
ওএনজিসি সাড়ে ৫ হাজার লাইন কিলোমিটার দ্বিতীয় মাত্রার ভূকম্পন জরিপ করে তেল-গ্যাস পাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখছে। এরপর তারা ২০২০ সালে কূপ খননের উদ্যোগ নেয়। যদিও এই কূপ খনন এক বছর পিছিয়ে গত ২৯ সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (বাপেক্স) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহম্মদ আলী নিউজবাংলাকে বলেন, কূপের ডিজাইনটি ৪ হাজার ২০০ মিটার গভীরে হচ্ছে। এর ৩ হাজার ৪০০ মিটার গভীরতায় উচ্চচাপ এলাকা (হাইপ্রেশার জোন) রয়েছে। এখানে মোট তিনটি কূপ খনন করা হবে। সব মিলিয়ে ১ দশমিক ৯ টিসিএফ গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সাগরে ব্লক ও অনুসন্ধানের গল্প
অনুসন্ধানের জন্য বঙ্গোপসাগরের অগভীর ও গভীর অংশকে মোট ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে অগভীর অংশে ব্লক ১১টি। আর গভীর সমুদ্রে ব্লক ১৫টি। অগভীর ব্লকে পানির গভীরতা ২০০ মিটার পর্যন্ত। এর পরে গভীর সমুদ্র ব্লক।
অগভীর সমুদ্রের ৯ নম্বর ব্লকে ১৯৯৬ সালে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে কেয়ার্নস এনার্জি, যা এখন পর্যন্ত দেশের একমাত্র সামুদ্রিক গ্যাসক্ষেত্র। ১৯৯৮ সালে সেখান থেকে গ্যাস উৎপাদন শুরু হয়। মজুত ফুরিয়ে যাওয়ায় ২০১৩ সালে গ্যাসক্ষেত্রটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।
এ ছাড়া কুতুবদিয়ার সাগরতীরে গ্যাসের সন্ধান মিললেও তা বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য বিবেচিত হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক তেল-গ্যাস কোম্পানি কনোকোফিলিপস ২০০৮ সালের দরপত্র প্রক্রিয়ায় গভীর সমুদ্রের ডিএস-১০ ও ডিএস-১১ নম্বর ব্লক ইজারা নিয়েছিল। দুই বছর অনুসন্ধান কাজ করার পর গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে মতভেদের কারণে ২০১৪ সালে ব্লক দুটি ছেড়ে দেয় কনোকো।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে ডাকা অন্য আরেক আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে গভীর সমুদ্রের ডিএস-১২, ডিএস-১৬ ও ডিএস-২১–এই তিন ব্লকের জন্য যৌথভাবে দরপ্রস্তাব জমা দিয়েছিল কনোকো ও স্টেট অয়েল। পরবর্তী সময়ে কনোকো নিজেকে সরিয়ে নেওয়ায় ব্লকগুলো ইজারা দেয়া সম্ভব হয়নি।
একই সময়ে অগভীর সমুদ্র্রের ব্লকগুলোর জন্য ভিন্ন একটি দরপত্র আহ্বান করে পেট্রোবাংলা। এই দর প্রক্রিয়া এসএস-১১ নম্বর ব্লক সান্তোস ও ক্রিস এনার্জি এবং এসএস-৪ ও এসএস-৯ নম্বর ব্লক ভারতীয় দুটি কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ ও অয়েল ইন্ডিয়া ইজারা নিয়েছিল।
যদিও একসময় সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের কারণে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের বাধার মুখে ছিল বাংলাদেশ। বিষয়টি আন্তর্জাতিক সালিশি আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
আদালতের রায়ে প্রায় ৯ বছর আগে (২০১২) মিয়ানমারের সঙ্গে এবং সাত বছর আগে (২০১৪) ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানা নিষ্পত্তি হয়। প্রায় এক লাখ ৩৮ হাজার ২৮৯ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চলে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়, যাকে ‘সমুদ্র বিজয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
গভীর সাগরের তেল-গ্যাস উত্তোলন নিয়েও তৈরি হয় নতুন সম্ভাবনা। কিন্তু সেই সম্ভাবনা কোনো কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এরপর জ্বালানি বিভাগ বিশেষ আইনে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেয়। দরপত্র প্রক্রিয়া ছাড়াই ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোর (আইওসি) কাছ থেকে আগ্রহপত্র চায় পেট্রোবাংলা।
সিঙ্গাপুরের ক্রিস এনার্জি, দক্ষিণ কোরিয়ার পোসকো দাইয়ু ও নরওয়ের স্টেট অয়েল আগ্রহ প্রকাশ করে। পরে প্রস্তাব চাওয়া হলে শুধু গভীর সমুদ্রের ১২ নম্বর ব্লকের জন্য দাইয়ু প্রস্তাব দাখিল করে। দীর্ঘ আলোচনার পর ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে দাইয়ু করপোরেশনের সঙ্গে উৎপাদন-অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) সই করে পেট্রোবাংলা। দাইয়ু এই ব্লকের পাশেই মিয়ানমারের একটি সমুদ্র ব্লক থেকে গ্যাস তুলছে। মিয়ানমার সেই গ্যাস রপ্তানিও করছে।
অতীত যা বলে
সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ইতিহাস খুব একটা সুখকর নয়। ২০১৪ সালে অনুসন্ধান কাজ বন্ধ রেখেই চলে যায় মার্কিন কোম্পানি কনোকোফিলিপস। সর্বশেষ সান্তোস আর দাইয়ুও চলে গেছে। গত মার্চে তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে পেট্রোবাংলা।
সান্তোস এসএস-১১ ব্লকে তিন হাজার ২০০ কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক জরিপ করেছে। এ ছাড়া ৩০২ বর্গকিলোমিটার ত্রিমাত্রিক জরিপ করে তথ্য পেট্রোবাংলার কাছে দিয়েছে। একটি কূপও খনন করার কথা চলছিল তাদের সঙ্গে। যদিও কোম্পানিটি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকা থেকেই নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে।
অন্যদিকে কোরিয়ান কোম্পানি দাইয়ু গভীর সমুদ্রে সম্ভাবনাময় ডিএস-১২ ব্লকে ৩ হাজার ৫৮০ কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক জরিপ করে তথ্য পেট্রোবাংলার কাছে জমা দেয়। এর পাশেই মিয়ানমার তাদের ব্লক থেকে গ্যাস তুলছে। মিয়ানমারে ওই ব্লকের অপারেটরও দাইয়ু। কাজের মধ্যেই পেট্রোবাংলার কাছে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আবেদন করে দাইয়ু। চুক্তি অনুযায়ী দাম বাড়ানোর সুযোগ না থাকায় পেট্রোবাংলা তা নাকচ করে। এরপরই দাইয়ু তাদের ব্লক ছেড়ে দেয়।
এদিকে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির পর সমুদ্রসম্পদ নিয়ে অনুসন্ধান, গবেষণা ও উত্তোলন তদারকির জন্য ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি ব্লু ইকোনমি সেল গঠন করে সরকার। এ সেলের জনবল নিয়োগ এখনও পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে ছয় কর্মকর্তাসহ বর্তমানে মোট জনবল ১০ জন। কয়েকটি বৈঠক ছাড়া এ শাখার তেমন কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়নি।
এলএনজিতে আগ্রহ বিদেশিদের
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, সমুদ্রে জরিপ ও অনুসন্ধান যতটা ব্যয়বহুল, তার চেয়েও বেশি ব্যয়বহুল সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে পাইপ লাইন তৈরি করে তেল বা গ্যাস স্থলে আনা। তাই ক্রমশ বহুজাতিক কোম্পানিগুলো পাইপ লাইনের পরিবর্তে সমুদ্রে এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের মাধ্যমে খনির গ্যাস এলএনজিতে রূপান্তর করে জাহাজে করে স্থলে আনতে আগ্রহী। এতে অল্প বিনিয়োগ তাদের জন্য বেশি লাভের হয়। এ জন্য কোম্পানিগুলো এলএনজি ব্যবসার দিকে ঝুঁকছে।
গ্যাস তুলছে মিয়ানমার-ভারত
২০১২ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির পর মিয়ানমার দ্রুত গ্যাস ব্লকগুলোতে অনুসন্ধান শুরু করে। ২০১৬ সালে থালিন-১ নামক ব্লকে গ্যাস পাওয়ার ঘোষণা দেয় দেশটি। থালিন-১ বড় গ্যাসক্ষেত্র। সাড়ে ৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট উত্তোলনযোগ্য গ্যাস আছে। এখান থেকে গ্যাস তোলা শুরু হয়েছে। এই মজুত আরও বাড়তে পারে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরের ভারতীয় অংশের কৃষ্ণা-গোদাবরি বেসিন এলাকায় প্রায় ৫০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ থাকতে পারে বলে আশা করছে ভারত। ভারতের সরকারি প্রতিষ্ঠান ওএনজিসি, গুজরাট এস্টেট পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, বেসরকারি শিল্প গ্রুপ রিলায়েন্স এ এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে কাজ করছে।
আগামী বছর রিলায়েন্স এই বেসিনের কেজি ডি-৬ ব্লকে তিনটি গ্যাস কূপ খনন করবে। আশা করা হচ্ছে, ২০২৩ সালের মধ্যে এখান থেকে গ্যাস উত্তোলন সম্ভব হবে।