বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘রাজাকারের’ প্রতারণা: ৩৭ বছর ধরে বীর মুক্তিযোদ্ধা

  •    
  • ২৮ অক্টোবর, ২০২১ ১৭:৩৩

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম তুলে তারা মিয়া বাগিয়ে নেন ঢাকার মোহাম্মদপুরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারিভাবে নির্মিত বহুতল ভবনে চার কক্ষের ফ্ল্যাট; যার দাম এক কোটি টাকা। তিনি এখানেই থেমেননি, ঈশ্বরগঞ্জের আঠারোবাড়ী ইউনিয়নের রায়ের বাজার এলাকায় নিজ গ্রাম ইটাউলিয়ায় সরকারিভাবে বরাদ্দ পান ১০ শতাংশ জমি। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে প্রতি মাসে তুলতেন সরকারি ভাতার টাকা।

ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের তারা মিয়া ছিলেন রাজাকার। প্রতারণা করে তিনিই তালিকাভুক্ত হন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে।

১৯৮৪ সাল থেকে ৩৭ বছর ধরে বীর মুক্তিযোদ্ধার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে আসছেন। ২০১১ সাল থেকে পাচ্ছেন ভাতাও। এর মধ্যে বাগিয়ে নিয়েছেন রাজধানীতে কোটি টাকার সরকারি ফ্ল্যাট ও নিজ এলাকায় জমিও।

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের পরোয়ানায় তাকে গ্রেপ্তার করে গত শুক্রবার কারাগারে পাঠানোর পর এ নিয়ে উপজেলাজুড়ে বইছে সমালোচনার ঝড়।

বিভিন্ন মাধ্যমে তদবির ও সংশ্লিষ্ট অসাধু কর্মকর্তাদের মাধ্যমে রাজাকার থেকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তারা মিয়ার নাম উঠেছে বলে অভিযোগ স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) ও মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভুয়া যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা তারা মিয়ার যোগসাজশ রয়েছে বলেও অভিযোগ তাদের।

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তারা মিয়ার নাম কোন কৌশলে তালিকায় ওঠানো হয়েছে? নামটি ভুলে উঠেছে, নাকি যাচাই-বাছাই করেই তোলা হয়েছে, বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ স্থানীয়রা তুলেছেন এসব প্রশ্ন।

সেই প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধান করেছে নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডটকম।

সরকারি নথিপত্র, গৌরীপুর ও ঈশ্বরগঞ্জে অনুসন্ধানে জানা যায়, ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার ধোপাজাঙ্গালিয়া গ্রামে তারা মিয়া নামের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা আছেন। তিনি প্রয়াত শমশের আলীর ছেলে। তার মুক্তিযোদ্ধা নম্বর ০১৬১০০০৬১৭১, বেসামরিক গেজেট নম্বর ৭৩৬, লাল মুক্তিবার্তা নম্বর ০১১৫১১০২৪৩ ও ভারতীয় তালিকা নম্বর ৯৭৯৩।

সরকারি নথিপত্রে সেই ‘যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা’ লিপিবদ্ধ হয়েছিলেন ঈশ্বরগঞ্জের তারা মিয়া। তার বাবার নামও সমশের আলী।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লাল মুক্তিবার্তায় ঈশ্বরগঞ্জের ‘যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা’ তারা মিয়ার পরিচিতি নম্বর ১১৫০২০২০৩, ভারতীয় তালিকা নম্বর ৯৭৯৩। নিজের নাম আর বাবার নাম হুবহু এক থাকলেও এই পরিচিতি নম্বরটি গৌরীপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা তারা মিয়ার সঙ্গে মেলেনি। তবে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার ভারতীয় তালিকা নম্বরটি গৌরীপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে হুবহু মিল।

এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধারা জানান, একজনের সঙ্গে আরেকজনের ভারতীয় তালিকা নম্বর কখনোই মিলবে না। যদি কারও মিলে যায়, তাহলে স্পষ্ট বোঝা যাবে এটি ভুয়া নম্বর। পাশের উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম ও বাবার নামের মিল থাকার সুযোগে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকায় নাম তুলেছেন তিনি।

তারা জানান, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম তুলে তারা মিয়া বাগিয়ে নেন ঢাকার মোহাম্মদপুরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারিভাবে নির্মিত বহুতল ভবনে চার কক্ষবিশিষ্ট একটি ফ্ল্যাট; যার দাম এক কোটি টাকা। তিনি এখানেই থামেননি, ঈশ্বরগঞ্জের আঠারোবাড়ী ইউনিয়নের রায়ের বাজার এলাকায় নিজ গ্রাম ইটাউলিয়ায় সরকারিভাবে বরাদ্দ নিয়েছেন ১০ শতাংশ জমি। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে প্রতি মাসে তুলতেন সরকারি ভাতার টাকাও।

ঈশ্বরগঞ্জ পৌর এলাকার সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জল হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তারা মিয়া রাজাকার হিসেবে পরিচিত। তিনি ভালো করেই জানেন রাজাকারের স্থান বাংলাদেশের মাটিতে নেই। নিজেকে বাঁচাতে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার পাতায় কৌশলে নাম লিখিয়েছেন। দ্রুত ফাঁসি কার্যকর করে কলঙ্ক মোচন করা দরকার।’ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার হাবিবুর রহমান আকন্দ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গৌরীপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা তারা মিয়ার নামসহ বাবার নাম মিলে যাওয়ার কারণেই ঈশ্বরগঞ্জের তারা মিয়ার নামটি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কৌশলে তোলা সম্ভব হয়েছে।

‘নামটি তুলতে নিশ্চয়ই অসাধু কিছু কর্মকর্তা সহযোগিতা করেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা তারা মিয়ার ভারতীয় মুক্তিবার্তা নম্বরটির সঙ্গে রাজাকার তারা মিয়ার ভারতীয় নম্বরটি একই রাখা হয়েছে। সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে নাম লিপিবদ্ধ করলে এমনটি হতো না।’হাবিবুর রহমান আকন্দ আরও বলেন, ‘১৯৮৪ সালের দিকে তারা মিয়া ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার খাতায় নাম লিখিয়েছেন। তিনি ভাতাসহ সরকারি সব সুবিধা ভোগ করেছেন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি ২০১১ সাল থেকে ভাতাসহ সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছিলেন।’

ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডের সাবেক কমান্ডার আব্দুস সাত্তার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তারা মিয়া মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রমাণ কখনোই দিতে পারবেন না। যদি তিনি গোপনেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন, তাহলে আমাদের উপজেলার কেউ না জানলেও তিনি কোথায় কাদের সঙ্গে থেকেছেন এবং যুদ্ধ করেছেন তারা বলতে পারতেন। তিনি নিজেকে বাঁচাতেই চতুরতার পরিচয় দিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বনে যান।’

তিনি আরও বলেন, ‘রাজাকার তারা মিয়াকে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ভিআইপি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বলেও নাম দিয়েছেন। কারণ, তিনি সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন; বীরদর্পে ছিলেন এই রাজাকার। তিনি মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে পঙ্গু হননি৷ দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়েছেন।’

কমান্ডার আব্দুস সাত্তার আরও বলেন, ‘২০১৭ সালে উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের সময় তারা মিয়া মুক্তিযোদ্ধা নন-মর্মে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছিল। সবশেষ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ট্রাইব্যুনাল থেকে জারি করা ওয়ারেন্টের ভিত্তিতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আমরা তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’গত ২১ অক্টোবর ময়মনসিংহের ১২ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এরপরই অভিযানে নামে কোতোয়ালি মডেল থানা ও ঈশ্বরগঞ্জ থানা পুলিশ।

পুলিশ জানায়, ওই দিনই বিকেল ৩টা থেকে শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ছয় আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। আরেক আসামিকে ২৩ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তার সাতজন হলেন ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার আঠারবাড়ি ইউনিয়নের ইটাউলিয়া গ্রামের তারা মিয়া ও হাবিবুর রহমান মেনু মিয়া, কালিয়ান গ্রামের রুস্তম আলী, সোহাগী বাজার এলাকার সৈয়দ মোস্তাফিজুর রহমান, ফানুর গ্রামের আব্দুল মান্নান, সোহাগী চরপাড়া এলাকার আব্দুল হান্নান এবং পৌরসভার কাকনহাটি এলাকার শহীদুল্লাহ ফকির।

একাত্তরে গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুণ্ঠনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আদালতের নির্দেশে সবাইকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

এ বিভাগের আরো খবর