মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাটে কাত হয়ে আংশিক ডুবে যাওয়া ফেরিটি ফিটনেস ছাড়াই পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে চলাচল করছিল বলে জানিয়েছেন অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) একজন কর্মকর্তা।
বিআইডব্লিউটিসির এজিএম (মেরিন) আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘উল্টে যাওয়া ফেরি শাহ আমানতের ফিটনেস ছিল না। ফিটনেসবিহীনভাবেই এটি নৌরুটে চলাচল করত। ফিটনেসের জন্য দীর্ঘদিন আগে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে আবেদন করা হয়েছিল।’
তবে ফেরিটি চার মাস আগে মেরামত করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয়ের ডিজিএম জিল্লুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘শাহ আমানত ১৯৭৯ সালে তৎকালীন আরিচা ফেরি সেক্টরে যোগ হয়। এরপর নাব্য সংকটের কারণে ২০০২ সালের পাটুরিয়া ফেরিঘাট স্থানান্তর করা হয় এবং ফেরির তলায় সমস্যা থাকায় গত চার মাস আগে নারায়ণগঞ্জ থেকে ফেরিটি মেরামত করা হয়।’
দুর্ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে ফেরির ব্যালাস্ট ট্যাংক ফুটো হয়ে যাওয়ায় এটি কাত হয়ে পড়েছে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক দিনোমনি শর্মা বলেন, ‘ব্যালেন্সের ওই ট্যাংক ফুটো হয়ে ভেতরে অতিরিক্ত পানি ঢোকার কারণে ফেরিটি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। যার ফলে ফেরি থেকে কিছু গাড়ি নেমে যাওয়ার পরে এক পাশে কাত হয়ে যায় বলে ধারণা করা হচ্ছে।’
ফেরিতে থাকা একটি কাভার্ড ভ্যানের চালক কামাল মিয়া বলেন, ‘বেনাপোল থেকে তুলা নিয়া গাজীপুর যাচ্ছিলাম, কিন্তু মাঝ নদীতে ফেরিতে পানি দেখি। মনে হচ্ছিল ফেরি ধুইছে তার পানি। পাটুরিয়া আসার পর যখন কয়েকটা গাড়ি আনলোড হইল, তখন ফেরিটি ডান দিকে কাইত হইয়া যেতে লাগল। এর পরই ওল্টাইয়া গেল। কোনো মতে লাফাইয়া জানে বাঁচছি। আরেকটু হইলে গেছিলাম। ফেরিতে সমস্যার কারণেই তো পানি উঠেছে। সমস্যা না হলে তো পানি উঠত না।’
বেঁচে যাওয়া আরেকটি কাভার্ড ভ্যানের চালক সেলিম মিয়া বলেন, ‘ফেরিতে পানি দেখেই ঘাটে আসা মাত্রই হেলপার ও মালিকের একজন দৌড়ে ফেরি থেকে নামেন। আমার আগে গাড়ি থাকায় নামাতে পারি নাই। তাড়াতাড়ি করে নামার সময় গাড়িটা পন্টুনে আটকায় যায়। পরে গাড়ি রাইখা জীবন বাঁচাইতে নদীতে লাফ দেই। আর আমার গাড়ি ভাসতে ভাসতে ভাটিতে চলে যায়।’
পাটুরিয়ার ৫ নম্বর ফেরিঘাটে বুধবার সকালে আমানত শাহ ফেরিটি হেলে পড়ে।
ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা দিনোমনি শর্মা জানান, হেলে পড়ার সময় ফেরিতে ১৪টি কাভার্ড ভ্যান, তিনটি ট্রাক ও সাত থেকে আটটি মোটরসাইকেল ছিল।
ফেরি ও এতে থাকা যানবাহন উদ্ধারে ঘটনাস্থলে বুধবার কাজ করছিল হামজা নামে উদ্ধারকারী জাহাজ। এর কমান্ডার ছানোয়ার হোসেন জানান, বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৯টি ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ও একটি মোটরসাইকেল পানি থেকে তোলা গেছে।
তিনি আরও জানান, উদ্ধারকাজে সহায়তার জন্য মুন্সিগঞ্জ থেকে প্রত্যয় নামের আরেকটি জাহাজ যোগ দেয়ার কথা।
ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা দিনোমনি জানান, রাতে উদ্ধারকাজ স্থগিত রাখা হয়। বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে আবারও শুরু হয় অভিযান। দুপুর ১২ টায় একটি কাভার্ডভ্যান উদ্ধার করে হামজা। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন গাড়ির মালিক কামাল হোসেন।
এদিকে পদ্মায় তীব্র স্রোতের কারণে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় এগোতে পারছে না বলে বৃহস্পতিবার সকালে নিউজবাংলাকে জানান এর কমান্ডার মাসুদ উল হক।
তিনি জানান, দুটি টাগবোটের বোর্ডের সাহায্যে মেঘনা নদী পাড়ি দিতে পারলেও পদ্মা-মেঘনার মোহনায় বুধবার রাত থেকে নোঙর করে রাখা হয়েছে প্রত্যয়কে।
মাসুদ বলেন, ‘গতকাল সন্ধ্যায় মেঘনা পাড়ি দিয়ে পদ্মা নদীতে প্রত্যয় নিয়ে এগোতে থাকি। অল্প কিছুদূর এগোলে পদ্মা নদীর তীব্র স্রোতের কারণে নোঙর করতে বাধ্য হই। রাতে কয়েকবার চেষ্টা করলে এগোনোর থেকে পিছিয়ে পড়ি।
‘প্রত্যয়কে তিনটি টাগবোট এবং জোয়ারের পানি আসলে চেষ্টা করা হবে এগোনো যায় কি না। তবে কতটা সফলতা আসবে তখন বোঝা যাবে। যদি এগোনো যায় তাহলে বিকেল নাগাদ পদ্মা সেতুর নিচ দিয়ে অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে। মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাটে কখন নাগাদ পৌঁছাব- এটা সঠিকভাবে বলা খুবই কষ্টকর।’
পদ্মায় তীব্র স্রোতের কারণে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় এগুতে পারছে না
ফেরি দুর্ঘটনার তদন্তে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাত সদস্যের কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে দুর্ঘটনার কারণ খুঁজে বের করে নৌপরিবহন সচিবের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে বুধবার এই নির্দেশনা দেয়া হয়।
মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ জানান, তাদের গঠন করা চার সদস্যের কমিটিকে পাঁচ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
এই দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত কারও হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। তবে পাটুরিয়া ঘাটে থাকা শিমু আক্তার নামের এক নারী বুধবার নিউজবাংলাকে জানান, তার স্বামী মো. তুহিন ওই ফেরিতে ছিলেন। দুর্ঘটনার পর থেকে তার খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা দিনোমনি শর্মা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখনও হতাহত কাউকে পাইনি। কেউ যদি ওই ফেরিতে থাকা কোনো স্বজন নিখোঁজ থাকার অভিযোগ করে, তাহলে আমরা বিষয়টি মাথায় রাখব।’