ছাত্রলীগে সাম্প্রতিক সময়ে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেয়ার অভিযোগে ১৬ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে সংগঠন থেকে। তাদের সংগঠনে অনুপ্রবেশকারী বলছে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ। তবে এদের বিষয়ে কুমিল্লার ঘটনার আগে তেমন ব্যবস্থা না নেয়াকে শীর্ষ দুই নেতার উদাসীনতা বলছেন ছাত্রলীগের অন্য কেন্দ্রীয় নেতারা।

সংগঠনের গঠনতন্ত্র সঠিকভাবে অনুসরণ করা হলে এমন ঘটনা এড়ানো যেত বলে মনে করেন ছাত্রলীগের ওই কেন্দ্রীয় নেতারা। আর ছাত্রলীগের অভিভাবক সংগঠন আওয়ামী লীগ বলছে, সংগঠনে এমন অনুপ্রবেশকারীদের জন্য সকল ফাঁকফোকর বন্ধ করা হচ্ছে। একই ধরনের মন্তব্য ছাত্রলীগ সভাপতিরও।

সম্প্রতি কুমিল্লার ঘটনার পর সারা দেশে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের কয়েকজনকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে উসকানি দিতে দেখা যায়। বিষয়টি সংগঠনের কেন্দ্রে অবগত হলে তাদের বহিষ্কার করা হয়।

শরীয়তপুর সদর উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা শহিদুল ইসলাম ঢালী এমনই একজন। শহিদুল সেখানকার সদর ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের আন্দোলনে নামার আহ্বান জানিয়েছেন। শহিদুলের মতো এমন মোট ১৬ জনকে ছাত্রলীগ থেকে বিভিন্ন ধরনের উসকানি দেয়ার জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে।

‘সম্প্রদায়িক উসকানিদাতারা’ দীর্ঘদিন ধরেই ছাত্রলীগে ঢুকতে সমর্থ হয়েছে বলে মনে করছেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতারা। সাম্প্রতিক ছাত্রলীগে গঠনতন্ত্র অনুসরণ করে সম্মেলনে কমিটি না দিয়ে ‘প্রেস রিলিজ’ কমিটি দেয়ায় এই অবস্থাটি গতি পেয়েছে বলে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন।

ছাত্রলীগের সহসভাপতি সৈয়দ আরিফ হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এমন ক্রাইসিস হলেই তো অনেকের আসল রূপ সামনে আসে। কিন্তু এদের প্রমোট করেছেন ছাত্রলীগের তৃণমূল নেতারা।

কুমিল্লার ঘটনায় ফেসবুকে উসকানিমূলক পোস্ট দেয়ায় শরীয়তপুর সদর ছাত্রলীগ নেতা শহিদুল ইসলাম ঢালীকে বহিষ্কার করা হয়

তিনি অভিযোগ করেন, ‘তৃণমূলকে নিয়ে আসলে আমাদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কোনো পরিকল্পনা নেই। এ জন্য নেতা আসে আর যায়, এ নিয়ে তৃণমূলের কোনো পরিবর্তন হয় না।‘ তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুসারে চললেই তো এমন সংকট আর হওয়ার কথা নয়। শুধু সংগঠনকে নয়, সংগঠনের বর্তমান শীর্ষ নেতারা নেত্রীর নির্দেশনাকেও তো গুরুত্ব দেন না।’

তিনি আরও অভিযোগ করে বলেন, ‘যারা সাম্প্রদায়িক পোস্ট দিয়েছেন তাদের বরিষ্কার করে সংগঠনের শীর্ষ দুই নেতা শুধু তাদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন। কারণ আগে থেকে তৃণমূলে সম্মেলনে কমিটি দেয়া গেলে এ অবস্থার মধ্যে পড়তে হতো না সংগঠনকে।’

ছাত্রলীগের আরেক কেন্দ্রীয় নেতা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আসলে যারা সংগঠনের সাম্প্রদায়িক উসকানিদাতা, তাদের মার্কিং করা আমরা যারা কেন্দ্রীয় নেতা তাদের অবশ্যই উচিত ছিল। কিন্তু আমাদের তো কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক কোনো দায়িত্বই দীর্ঘদিন বণ্টন করে দেন না। এ কারণেই তো আমরা কাজ করতে পারি না।’

ছাত্রলীগের এক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ছাত্রলীগে অনেক দিন ধরেই এরা ঢুকেছে। কিন্তু আমাদের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের আগে কোনো বিকার দেখা যায়নি। এখন সংকটে তাদের আসল রূপ বের হতে শুরু করেছে। আর সংগঠনের দীর্ঘদিনের যে একটি অসাম্প্রদায়িক ইমেজ তা ক্ষুণ্ন হতে বসেছে। তবে গঠনতন্ত্র মেনে যদি বিভাগ ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটিগুলো হলে এমনভাবে তারা ঢুকতে পারত না।’

ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক ইন্দ্রনীল দেব শর্মা রনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক উসকানি দেয়ার জন্য ১৬ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। যারা ঢাকা মহানগর, জেলা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা। আরও বেশ কয়েকজন পর্যবেক্ষণে রয়েছে বলে জানান তিনি।

কীভাবে এরা সংগঠনে প্রবেশ করতে পারল জানতে চাইলে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘দুটি কারণ হতে পারে। তার একটি হলো নেতৃত্ব পদায়নের সময় যাচাই-বাছাইয়ে গাফিলতি ছিল। আর একটি হলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এদের কেউ কেউ অনুপ্রবেশ করে থাকতে পারে।’

সাম্প্রদায়িক উসকানি ছড়িয়ে পদ হারানো যশোরের ছাত্রলীগ নেতা মেরাজ হোসেন মিঠু (বাঁয়ে) এবং পরে ক্ষমা চেয়ে দেয়া ফেসবুক স্ট্যাটাস।

যা বলছে আওয়ামী লীগ

ছাত্রলীগের মধ্যে এই ‘সাম্প্রদায়িক উসকানিদাতা নেতাদের বিষয়ে কড়া নজর রাখা হচ্ছে জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। এ বিষয়টিতে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও দল থেকে ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এদের ছাত্রলীগ হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। কারণ ছাত্রলীগ একটি আদর্শভিত্তিক সংগঠন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটি সংগঠন। কাজে এই সংগঠনের ভেতরে যদি কেউ সাম্প্রদায়িক উক্তি করে তাহলে ধরে নিতে হবে সে কোনোক্রমেই ছাত্রলীগের না। সে ছাত্রলীগের ভেতরে অনুপ্রবেশকারী।’

কিন্তু তারা কীভাবে ছাত্রলীগে প্রবেশ করল জানতে চাইলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় আছি। ক্ষমতায় থাকাকালীন তারা বিভিন্ন ফাঁকফোকরে ঢুকে পড়ে। তবে এই ফাঁকফোকরগুলো আমরা বন্ধ করার চেষ্টা করছি।’

এর আগে ২৯তম সম্মেলনের মাধ্যমে ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক হন গোলাম রাব্বানী। তবে এক বছর গড়াতেই অনিয়ম ও চাঁদাবাজির অভিযোগে শোভন-রাব্বানীকে ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর অপসারণ করা হয়।

শোভন-রাব্বানীকে অপসারণের পর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, এক নম্বর সহসভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়কে সভাপতি ও এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। কয়েক মাস ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও ২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি তাদের ভারমুক্ত করে পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব দেয়া হয়।

প্রেস রিলিজ কমিটি নিয়ে ক্ষোভ অব্যাহত

এদিকে করোনা মহামারি ও বন্যাসহ বিভিন্ন সংকটে মানুষের পাশে দাঁড়ালেও সাংগঠনিক কার্যক্রম গোছাতে পারেননি নতুন নেতারা। সম্মেলন ছাড়া ‘প্রেস রিলিজ’ কমিটি হওয়ার পর বেশ কিছু জায়গায় কমিটি দেয়ার পর ক্ষোভের সম্মুখীন হয়েছেন ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতা।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রের মধ্যে প্রেস রিলিজ কমিটি নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরেই ক্ষোভ বিরাজ করছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনের নেতারা। এ নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। কমিটি প্রত্যাখ্যান করে হয়েছে প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ। দীর্ঘদিন কেন্দ্র থেকে সম্মেলন না হওয়ায় সংগঠনের তৃণমূল নেতাদের কারা আসছেন সেটা জানতে পারছেন না কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতারা।

এ ছাড়া কমিটি গঠন নিয়ে অর্থ লেনদেনের মতো স্পর্শকাতর অভিযোগও রয়েছে বেশ কয়েকটি। সংগঠনের মধ্যে অর্থের বিনিময়ে ছাত্রদল ও শিবিরকর্মীদের কমিটিতে জায়গা দেয়ার মতো অভিযোগ এখন অনেক। সম্প্রতি সংগঠনের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উসকানিদাতাদের বহিষ্কার করা হলেও প্রশ্ন উঠেছে তারা কীভাবে সংগঠনে প্রবেশ করল?

এ জন্য অবশ্য অনেকে প্রেস রিলিজ কমিটি ছাড়াও কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে সাংগঠনিক দায়িত্ব বণ্টন না করাকে দায়ী করছেন। এতে হতাশ সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক নেতাও।

সবশেষ সিলেটে প্রেস রিলিজ কমিটি দেয়ার পর সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি ঘোষণার পর তা প্রত্যাখ্যান করে সড়ক অবরোধ ও টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে ছাত্রলীগের একটি অংশ। অর্থের বিনিময়ে কমিটির শীর্ষপদ দেয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ এনেছেন তারা। এভাবে কমিটি করায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের এক অংশ ক্ষোভও প্রকাশ করে। এভাবে কমিটি ঘোষণা করাকে তারা গঠনতন্ত্রবিরোধী আখ্যা দিয়েছেন।

পীরগঞ্জে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় অভিযুক্ত সৈকত মণ্ডল রংপুর কারমাইকেল কলেজের ছাত্রলীগ নেতা। সহিংসতার পর তাকে সংগঠন থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

ছাত্রলীগ সভাপতির বক্তব্য

‘সাম্প্রদায়িক উসকানিদাতাদের’ যে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে, সংগঠনে তারা কীভাবে ঢুকেছিল জানতে চাইলে ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ছাত্রলীগ ৫০ লাখ নেতা-কর্মীর সংগঠন। আমরা চেষ্টা করি কোনো অনুপ্রবেশকারী যাতে সংগঠনে ঢুকে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করার জন্য যাতে সংগঠন করতে না পারে। আমাদের যাচাই-বাছাইয়ের পরও দুই-এক জায়গায় ভুল হয়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘আমরা এই সাম্প্রদায়িক উসকানিদাতাদের কোনোভাবেই ছাড় দিচ্ছি না। আমরা এমন অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি। কিছু চিহ্নিত করেওছি। তাদের আমরা সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে দিয়েছি। আমরা শুধু এই সাম্প্রদায়িক উসকানিদাতাদের গঠনতন্ত্র মেনে বহিষ্কার করতে পারি। কিন্তু আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের বিষয়ে অবগতও করছি।’

প্রেস রিলিজ কমিটি নিয়ে কেন্দ্রের অন্য নেতাদের ক্ষোভ প্রসঙ্গে ছাত্রলীগ সভাপতি বলেন, ‘করোনার মহামারিতে প্রতিটি জেলায় সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি। এর আগে সম্মেলন করে কমিটি করা সম্ভব হয়েছিল বলে দাবি করেন তিনি।

রংপুরের কারমাইকেল কলেজের ছাত্র না হয়েও সৈকত মণ্ডল কীভাবে সংগঠনের পদ পেল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনুপ্রবেশকারীদের যে ঘটনাগুলো আমরা বলছি, এটাই এখানে ঘটেছে। এ বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।’