রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দু অধ্যুষিত একটি গ্রামে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ‘হোতা’ হিসেবে রংপুরের কারমাইকেল কলেজের সদ্য সাবেক যে ছাত্রলীগ নেতার নাম এসেছে, তিনি ওই কলেজের ছাত্রই ছিলেন না।
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে অভিযুক্ত সৈকত মণ্ডল কারমাইকেল কলেজে সংগঠনটির দর্শন বিভাগের কমিটির ১ নম্বর সহসভাপতির দায়িত্বে থাকলেও তিনি আসলে রংপুর সরকারি কলেজের ছাত্র।
বিষয়টি ধরা পড়ার পর ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এখন বলা হচ্ছে, কারমাইকেল কলেজের দর্শন বিভাগের কমিটিতে পদ পেতে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলেন সৈকত মণ্ডল।
রংপুর মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আসিফ হোসেন নিউজবাংলার কাছে স্বীকার করেছেন, সৈকত রংপুর সরকারি কলেজের ছাত্র। তিনি সংগঠনে ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলেও দাবি করেছেন আসিফ।
সৈকতকে ‘অনুপ্রবেশকারী’ দাবি করে রংপুর মহানগর ছাত্রলীগের দেয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
সৈকত দর্শন বিভাগের যে কমিটিতে ছিলেন, সেটি ২০১৭ সালের ৮ আগস্ট অনুমোদন দেন কারমাইকেল কলেজ শাখার সভাপতি সাইদুজ্জামান সিজার ও সাধারণ সম্পাদক জাবেদ আহমেদ। এ সংক্রান্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তির অনুলিপি পেয়েছে নিউজবাংলা।
কারমাইকেল কলেজ ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সভাপতি সাইদুজ্জামান সিজারের দাবি, সৈকত নিয়মিত কারমাইকেল কলেজে আসতেন এবং ক্লাস করতেন। তাই দর্শন বিভাগের কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন।
তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখে যায়, সৈকত রংপুর সরকারি কলেজের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের দর্শন বিভাগের ছাত্র। তার রোল নম্বর-৯১০২৪০৯ ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর-১৫২১৭১১২৩৯২। কলেজ কোড-৩২০৭। ২০১৯ সালের চতুর্থ বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষায় তিনি জিপিএ ৩ দশমিক ১ শূন্য পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
কারমাইকেল কলেজের দর্শন বিভাগের শিক্ষক ও কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করে নিউজবাংলাকে বলেন, কারমাইকেল কলেজে সৈকতের সরব উপস্থিতি ছিল। যেকোনো কাজে সবার আগে উপস্থিত থাকতেন তিনি। তার দাপটে অন্যরা ছিলেন কোণঠাসা।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর চূড়ান্ত পরীক্ষার ক্ষেত্রে এক কলেজের শিক্ষার্থীদের সিট সাধারণত অন্য কলেজে পড়ে। এই হিসেবে রংপুর সরকারি কলেজের পরীক্ষার্থীদের সিট পড়ে থাকে কারমাইকেল কলেজে।
২০১৭ সালে স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষার সময় কারমাইকেল কলেজের তৃতীয় ভবনের ২০৮ নম্বর কক্ষে রংপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী হিসেবে পরীক্ষা দেন সৈকত। তখন প্রথমবারের মতো কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক-কর্মকর্তার কাছে সৈকতের প্রকৃত পরিচয় ধরা পড়ে। তবে ছাত্রলীগ নেতা হওয়ায় বিষয়টি সবাই চেপে যান।
কারমাইকেল কলেজের দর্শন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান বশিরুল হাসান সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তিনি (সৈকত) এখানকার ছাত্র না। কখনও ক্লাসে দেখিনি। তবে তিনি এখানে খুব ঘোরাঘুরি করতেন। তার রেজাল্ট শিটে দেখেছি তিনি রংপুর সরকারি কলেজের ছাত্র।’
রপুরের পীরগঞ্জে হিন্দুপল্লিতে গত ১৭ অক্টোবরের হামলার পর র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন সৈকত মণ্ডল। এরপর সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘সৈকত মণ্ডলই এ ঘটনার হোতা। টঙ্গী থেকে শুক্রবার রাতে সৈকত ও তার সহযোগী রবিউল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃতরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অরাজকতা তৈরি এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের লক্ষ্যে হামলা-অগ্নিসংযোগ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার এবং মাইকিং করে হামলাকারীদের জড়ো করেন বলে জানিয়েছেন। সৈকত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানিমূলক, বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যাচারের মাধ্যমে স্থানীয় জনসাধারণকে উত্তেজিত করে তোলেন। এ ছাড়া তিনি ওই হামলা ও অগ্নিসংযোগে অংশ নিতে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করেন।’
গ্রেপ্তার হওয়ার পর সৈকত ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ স্বীকার করেছেন। এরপর তাকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত।
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, সৈকতের বাবা রাশেদুল ইসলাম রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় না থাকলেও দাদা আবুল হোসেন মণ্ডল রামনাথপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এবং তার চাচা রেজাউল করিম রামনাথপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ৬ নম্বর ইউনিটের সভাপতি।
রংপুর মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি শফিউর রহমান স্বাধীন ও শেখ আসিফ হোসেনের সই করা একটি বিজ্ঞপ্তি পেয়েছে নিউজবাংলা। এতেও উল্লেখ করা হয়, সৈকত মণ্ডল রংপুর সরকারি কলেজের ছাত্র।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘একটি কুচক্রী মহল উক্ত ব্যক্তিকে (সৈকত) বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে গুজব ও অপপ্রচার করার চেষ্টা করছে। মূলত সে তার ছাত্রত্ব পরিচয় গোপন রেখে ছাত্রলীগ কারমাইকেল কলেজ শাখার আওতাভুক্ত দর্শন বিভাগ শাখার সহসভাপতি পদে কৌশলে অনুপ্রবেশ করে। কারমাইকেল কলেজ শাখার তৎকালীন সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক অনেক আগেই তথ্য গোপন ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে।
‘বিভিন্ন রকম বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সংগঠনে অনুপ্রবেশ করে ষড়যন্ত্র করাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। এমন অনুপ্রবেশকারী অপরাধীর দায় সংগঠনের হতে পারে না।’
সৈকতকে কারমাইকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে
রংপুর মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আসিফ হোসেন বিজ্ঞপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রেসরিলিজ আমরা দিয়েছি। সৈকত কারমাইকেলে কলেজের ছাত্র নন। তিনি কৌশলে ভুল তথ্য দিয়ে প্রবেশ করেছেন। তিনি অনুপ্রবেশকারী। কলেজ কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ায় আমরা কমিটির বিলুপ্ত করেছি। সৈকত রংপুর সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগের ছাত্র, কিন্তু রংপুর কলেজ ছাত্রলীগে তার কোনো নাম নেই।’
সৈকতকে নিয়ে বিতর্কের পর বিলুপ্ত করা হয়েছে কারমাইকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কমিটি
কারমাইকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের (সদ্য বিলুপ্ত) সভাপতি সাইদুজ্জামান সিজার জানান, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে সৈকতকে ১৮ অক্টোবর সংগঠন থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
কীভাবে সৈকত পদ পেল, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সে (সৈকত) তো নিয়মিত কলেজে ক্লাস করেছিল। কলেজেই থাকত। তাই সে কমিটিতে স্থান পেয়েছে।’